অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের পাঠক্রম শেষে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাধারণ জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বার্তি ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই একটু ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য এই ক্লাস।
ক্লাসের পিছনের দিকে ভোম্বল দাসের রিজার্ভ সিট। ওখানে বসার অধিকার ওর নেতৃত্বাধীন চ্যালাদের। স্যার ভুবনমোহন দেব ক্লাসে ঢুকে নমস্কার করলেন। ছাত্ররা সকলেই প্রতিনমস্কার করল। ভোম্বল ওরফে ভ্যাবলা বলল, স্যার আমরাও তাহলে প্রণম্য ব্যক্তি নিশ্চয়ই। স্যার বললেন তোমরা নমস্কার করলে সেটা ফিরিয়ে দিতে এই ব্যবস্থা নমস্কার করা।
ভোম্বল – তাহলে স্যার পরীক্ষার খাতায় লিখতে না পারলে প্রতিলিখনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। আচার আচরণ সবার এক হওয়া উচিত। আপনি দাঁড়ালে আমরা দাঁড়াই। আবার আপনি বসলে পরে আমরা বসি। তাহলে আমরা দাঁড়ালে আপনারও দাঁড়ানো উচিত। আমাদের মেরুদন্ড সোজা রাখতে আপনার মেরুদণ্ডও সোজা ও সচল রাখা উচিত।
ভুবন বাবু বললেন যেমন—–
উত্তরে ভোম্বল বলল– আপনারা যা শেখান আমরা তাই শিখি। আর এই শিখতে শিখতেই তৈরি হয় শিক্ষক। পরীক্ষায় পাশ ফেল হয় আপনাদের জন্য। ক্লাসের সবাই ছাত্র। তাহলে সকলেই সমান। নাম্বার কেন কমবেশি হবে। আপনারা নিশ্চয়ই সমান চোখে আমাদের দেখেন না। আমরা কিন্তু আপনাদের সকল মাষ্টারমশাইকে সমান চোখে দেখি। সবাই আপনারা শ্রদ্ধার পাত্র। আপনাদের প্রাপ্য নাম্বার আমাদের কাছে সমান। সবাই আপনারা এক মানের ও এক সম্মানের। বেতন কাঠামো অনুযায়ী এক। সামনের বেঞ্চ আর পেছনের বেঞ্চের পার্থক্যটা আপনারাই গড়ে দেন। ভালো মন্দ ছেলে আপনারাই গড়েন। আমাদের বাবা মায়ের কাছে সব সন্তান সমান। আর আপনারা পার্থক্য গড়ে দেন। দাগ মারলে তো দাগী হবই। কালি সবার কলমের এক। তবুও কালিমালিপ্ত করেন আপনারা। এই কালি যদি আপনাদের জামাতে ছিটিয়ে দিই, তাহলে সেই দাগ উঠবে না! তাই কালিকে সমান চোখে দেখা দরকার। নাম্বারের মধ্যে লাল কালি তলায় মেরে ভাগ সৃষ্টি করছেন। আপনাদের যদি স্বাক্ষরে লাল মারা হয়, কেমন লাগবে বলুন? আমরা স্কুল না এলে লাল কালির দাগ আর আপনাদের বেলায় লালদাগ হবে না কেন?
আমরা চুলের টেরি ফাটালে আপনাদের রাগ হয়। আর আপনারা টেরি ফাটিয়ে স্কুলে এলে দোষণীয় নয় কেন? মোবাইলে আপনারা বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আপনাদের ছেলে মেয়ে সংসারের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। আর আমরা মোবাইল আনতে পারবনা কেন? বাড়িতে অসুস্থ বাবা বা ভাইবোনেরা খেলো কিনা জানতে পারি না? বাড়িতে আমাদের ভরণপোষণে খাদ্য জোগাড়ে বাপ মায়ের ছোটাছুটি। অর্থের জন্য হাত পেতে ভিক্ষা বাপ মায়ের। আর এখানে আপনারা আমাদের সন্তান মনে করেন না। সন্তান বাড়িতে রেখে এসেছেন ওটাই আপনাদের। এই বৈষম্য ফারাক আপনাদের সৃষ্টি। সব ছাত্ররা আপনাদের সন্তান এটা মানতে পারছেন না। কেউ থাকবে দুধে ভাতে আর কেউ হাভাতে।
আপনারা পূজা পার্বণ শীত উপভোগ করেন। আর আমরা চাইনা পূজা পার্বণ আসুক বা জমিয়ে শীত পড়ুক। পূজা পার্বণ ধনীদের। মুখের রুচি ও পোশাক পরিচ্ছদের জন্য তাদের প্রতিযোগিতা। আর শীতের পোশাক পরিধানে শীত উপভোগ করা।
আর আমরা হতচ্ছাড়া শ্রেণীর। নুন আনতে পান্তা ফুরায় আমাদের। শীতের তাড়াতাড়ি বিদায় জানাতে চাই। শীতের জ্বালা মেটাতে খড় কুটো জ্বালিয়ে শরীরে তাপ উপলব্ধি করি। ভগবানের নাম নিয়ে ধনী গরীবের পার্থক্য গড়ি। ভগবান ধনী গরীব করেছেন ব্যাখ্যা দেন আপনারা। ভগবান সবাইকে সমান চোখে দেখতে আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন পৃথিবীতে। আর আপনারা কেউ কেউ গগণচুম্বী অট্টালিকা বানিয়ে আমাদের ঝুপড়িকে আঁধারে ঠেলে দিচ্ছেন। আমাদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে গরীবে রূপান্তর করে ভগবানের দোহাই দিচ্ছেন।
আর ভগবানই বা কেমন? হাতে অস্ত্র সুসজ্জিত। তবুও ব্যবহার করেন না। যারা গরীবের শ্রম ধনসম্পত্তি চুরি করে নিচ্ছে, তাদের ওই অস্ত্রে সমুচিত জবাব দেওয়া উচিত। আসলে দেবদেবী মাটির। খড়ে প্রলেপ দিয়ে স্থাপন করে প্রণাম পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে আমাদের মতো গরীবদের ঠকানোর ব্যবস্থা। ভগবান থাকলে শ্রেণীহীন সমাজ থাকত। ভগবান নেই বলেই এই সব অসাম্য অরাজকতা। ধনীরা আজ ভগবান । আমাদের সেবা যত্নে তারা বলীয়ান। আবার ওই ত্রিশুলে কাড়ে আমাদের প্রাণ।
মাষ্টারমশাই চোখে রুমাল ঢেকে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। সরকারি চাকর তিনি। তাই বিরুদ্ধাচরণ করার স্পর্ধা তাঁর নেই।