লেখক- সঞ্জীব মজুমদার
আমরা মেয়েরা, ঠিক করতে পারি না আসলে আমার বাড়ি কোনটা! নিজের বাড়িতে যখন বড়ো হতে থাকলাম, তখন ঠাম্মি বলতে শুরু করলেন, দাঁড়া! কিছুদিন গেলেই তোকে তোর শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেব। এমনি করে সেই সময়টা একদিন এসেই গেল। সকলে মিলে হৈচৈ করে পাঠিয়ে দিলেন সেই বাড়িতে। যেখানে সকলেই অচেনা। ভাগ্যটা আমার এতো ভালো, সকলে আমায় শিখিয়ে দিল। সেখানে সকলকে আপন করে নিস। ওটাই তোর বাড়ি। বাঃ! শুনে একটু আনন্দ পেলাম। সেখানে পৌঁছে, দেখি আজব ব্যাপার! কতো সাজগোজ! কতো আলো! মনে মনে ভাবলাম, বাড়িটা আমার বেশ তো! কথাগুলি ভাবতে ভাবতেই একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়তে শুরু করলাম। কি গো নতুন বৌ, তোমার বাপের বাড়ি থেকে কী কী দিলো? এই শুরু হয়ে গেল আমার জীবনে একটু খানি ভালো লাগার স্বপ্নের বাঁধ ভাঙা। তারপর থেকে শুধুই প্রশ্ন, আর আমার উত্তর। নতুন বৌ বাপের বাড়ি থেকে কী এনেছ? কী দিয়েছে? আরও কত কি! এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে পেরিয়ে গেল ৮টি বছর। তারপরও যেন পিছু ছাড়ে না প্রশ্ন। হঠাৎ একদিন, ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল। আবার কি! শাশুড়ি মা বলে উঠলেন, এবাড়িতে এসব চলবে না। এটা বাপের বাড়ি না। এবাড়িতে অলক্ষ্মীর কোনও জায়গা নেই। মেয়েটা আমার একটু বুঝতে শিখেছে। হঠাৎ সে আমায় জিজ্ঞেস করে, মা এটা তোমার বাড়ি না? কিছু না ভেবে একটু থমকে গেলাম। আর বললাম, তোর ঠাম্মিকে জিজ্ঞেস কর। মেয়েটাও হাওয়ার বেগে ঠাম্মির কাছে ছুটে গিয়ে বলল, ও ঠাম্মি! আমরা কাদের বাড়িতে থাকি? তার ঠাম্মি বলল, কেন? আমরা আমাদের বাড়িতে থাকি। মেয়েটা আবার বলল, তাহলে এটা আমার বাবারও বাড়ি? তার ঠাম্মি বলল, হা তো। বাচ্চা মানুষ তো না বুঝে বলে উঠল, তা হলে ঠাকুরদা, কাকু, পিসি, আমার তোমার সকলের বাড়ি এটা? ঠাকুর দাদা বলল, হারে দিদি, এটা আমাদের সকলের বাড়ি। অবুঝ মেয়ে আবার বলে উঠল, তাহলে আমার মায়েরও বাড়ি? ব্যস! সব শেষ। শাশুড়ী মা বলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ওওওওও এই শেখনো হচ্ছে আজ কাল? ভালো শিক্ষা দেওয়ার নাম নেই। কার বাড়ি কার কি! বলি বাপের বাড়ি থেকে কী দিয়েছে কী শুনি? ওতো একটু লিক লিকে। তা আর বলে… এর মধ্যে শ্বশুরমশাইকে একটু বলতে শুনা গেল, আহা! থাক না। তখনই শাশুড়ী মা বলে উঠলেন, না বুঝেছি। অতো বলতে হবে না। তখনই ভাবলাম, যে মানুষগুলোকে আপন করতে আজ আমি ৮টি বছর কাটিয়ে দিলাম, আমার সকল শখ, আহ্লাদ ত্যাগ করলাম, সব বৃথা? তবে আমার বাড়ি কোথায়? কোনোদিন রাগ করে যদি বাপের বাড়িতে যাই, তখন আমার মা, বাবা, ঠাম্মি সকলেই বুঝাতে শুরু করে দেয়। রাগ করতে নেই। ওটা তোর শ্বশুর বাড়িই। তোর নিজের বাড়ি। আবার কখনো মেয়েটা দুষ্টুমি করলে আমি একটু বকা দিলে, শ্বশুরমশাই বলে ওঠেন, নাতনিকে। না না দিদিভাই, মা বকেছে, ঠিক আছে তাড়িয়ে দেবোখনে বাড়ি থেকে। তখনও ভাবতে বাধ্য করে, আমার বাড়ি কোথায়? মনে পড়ে, সেই ছোটবেলার কথা। সেই ভাই বোনরা সব একসাথে খেলাধুলো। আবার ভাবতে বাধ্য করে আমার বাড়ি কোনটা?