কুমার বিক্রমাদিত্য, কলকাতা: ব্যান্ডেজ করা পা দেখিয়ে 7 শতাংশ ভোট বাড়িয়েছেন মমতা। যা বিজেপি নেতাদের সমস্ত রাজনৈতিক সমীকরণ ওলট-পালট করে দিয়েছে। এই 7 শতাংশ ভোট বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান করেছে অনেক। এর ফলে 92টা আসনে মাত্র এক হাজারেরও কম ভোটের ব্যবধানে হেরেছে বিজেপি।
কথাই বলে পুরুষের এক কলা আর মেয়েদের 16 কলা। নারীদের ছলনার অভাব হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মে সেই প্রাচীনকাল থেকে মেয়েরা ছলনা করে মন গলিয়ে দিতে পারেন সাধারণ মানুষের। শুধু সাধারণ মানুষ নয় ইতিহাসে দেখা গিয়েছে এই চোখের জল দেখিয়ে অনেক রাজা মহারাজাকেও বশ করেছেন নারীরা।
10 মার্চ নন্দীগ্রামে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ভোট প্রচারের সময় গাড়ির দরজায় ধাক্কা লেগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পায়ে চোট পান। এরপর সেই ব্যথা পা নিয়ে তিনি সোজা চলে আসেন এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানে ব্যান্ডেজ করার পর বড় কোনো আঘাতের চিহ্ন না পাওয়া গেলেও, সেই যে পায়ে ব্যান্ডেজ করেছিলেন বিধানসভা ভোটের অষ্টম দফা নির্বাচনের আগের প্রচার শেষ না হওয়া অবধি তিনি সেই ব্যান্ডেজ খোলেননি। প্রতিটি জনসভাতে, প্রতিটি রোড শোয়ে তিনি এই ব্যান্ডেজ করা পা দেখিয়ে মানুষের সিমপ্যাথি বা সহানুভূতি আদায় করেছেন। এমনকি তিনি প্রকাশ্য জনসভায় অভিযোগ করেছেন যে, চক্রান্ত করে বিজেপি তার পা ভেঙে দিয়েছে। রাজ্যজুড়ে শিক্ষিত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ মমতার পায়ে ব্যান্ডেজ করা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। কারণ তার পায়ে যে সামান্য চোট লেগেছে তা এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে যাওয়ার কথা। সে সময় ডাক্তাররা তার পা দেখে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে এটুকু আভাস পাওয়া যায়।
রাজ্যের অধিকাংশ রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের ধারণা ছিল, ভোটের সময় মানুষের সহানুভূতি আদায়ের জন্য মমতা পায়ে ব্যান্ডেজ করেছেন। তা না হলে প্রকাশ্য জনসভায় কেন পায়ের ব্যান্ডেজ করা অংশটি তিনি দেখাবেন? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই ব্যান্ডেজ করা পা দেখিয়ে মমতা তৃণমূলের ভোট বাড়িয়েছেন প্রায় 5 থেকে 7 শতাংশ। এর ফলে লোকসভায় অনেক হেরে যাওয়া আসনেও হিসেব এলোমেলো করে দিয়েছেন মমতা। এককথায় একে বলা যেতে পারে ড্যামেজ কন্ট্রোল। এই সহানুভূতি ভোট বৃদ্ধির ফলে অনেক বিধানসভায় তৃণমূলের পাঁচ থেকে দশ হাজার অতিরিক্ত ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে বিষয়টি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেও এটা মানতে হবে, রাজ্যের এখনও একটি সিংহভাগ মানুষ সহজ সরল মনের। রাজনীতির জটিল প্যাচ তাদের মাথায় ঢোকে না। তারা রাজ্যের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের দুঃখে তারা কাঁদেন, আনন্দে হাসেন। এদের অনেকেই অল্প শিক্ষিত, স্বাক্ষর অথবা নিরক্ষর। এরা অনেকে রাজনীতি করেন আবার অনেকে তার ধার ধারেন না। মমতার ব্যান্ডেজ করা পা দেখে এইসব নিরীহ মানুষের মন গলেছে এতে সন্দেহ নেই। আর এই ব্যান্ডেজ করা পায়ের উপর সাফল্যের সৌধ গড়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যে যে জনসমর্থন তলানিতে ঠেকেছে তা আগেই বুঝেছিলেন মমতা। আর সেই ড্যামেজ কন্ট্রোল এর অন্যতম হাতিয়ার ছিল দুয়ারে সরকার। দুয়ারে সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে আর কিছু না হোক একটা অংশ মানুষকে সামাল দিতে পেরেছেন। আর স্বাস্থ্য সাথী কার্ড ছিল তার মধ্যে অন্যতম মোক্ষম অস্ত্র। বিশেষ করে গ্রামের ও দরিদ্র শ্রেণীর পরিবারের মহিলাদের মন জয় করেছে স্বাস্থ্য সাথী। তারা এই কার্ডের মাধ্যমে আদৌ কোন সুবিধা পাবেন কিনা তা আগুপিছু না ভেবে সেটাকে গ্রহণ করেছেন। তাদের ধারণা হয়েছিল এটা হয়তো ভবিষ্যতে দুঃসময়ে কাজে লাগতে পারে।
গত লোকসভা ভোটের সময় থেকে বিজেপির বিপুল ভোটে জয়ের পরেও এমন আশা করা যায়নি যে, 2021 এ বিধানসভা ভোটে বিজেপির জয় লাভের মত পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই করোনা পরিস্থিতি আম্ফান দুর্নীতি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণে রাজ্যে বিজেপির পক্ষে একটি জোর পরিবর্তনের হাওয়া তৈরি হয়। এমনকি তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাবেভাবে তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। 2020 এর একুশে জুলাইয়ে শহীদ দিবস পালনের সময় ভার্চুয়াল সভায় মুখ্যমন্ত্রীর মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল ‘এবার যদি আমরা ক্ষমতায় আসি…’ -এই কথাটি। আর সেই মন্তব্য নিয়ে বিজেপি নেতারা উদ্ধৃতি করে সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন বিধানসভা ভোটে তৃণমূল হারছে তা মমতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
কিন্তু দুরভিসন্ধি, পরিশ্রমী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভা ভোটের পর থেকেই এই সঙ্কট থেকে তৃণমূলকে উদ্ধার করার পথ খুঁজছিলেন। লাগাতার বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার, একের পর এক ড্যামেজ কন্ট্রোল করার অস্ত্র আবিস্কার মমতাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। দুয়ারে সরকার, দুয়ারে সমাধান, স্বাস্থ্য সাথী, বাংলার মেয়েকে চায়, রাজ্যের মানুষকে বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এনআরসি জুজু দেখানো, এমনকি বাংলাদেশ থেকে আসা এ রাজ্যের তথাকথিত শরণার্থীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন মমতা। এরপর ছিল আয়ুষ্মান ভারত ও স্বাস্থ্য সাথীর মধ্যে তফাতটা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া। এ ব্যাপারে বিজেপি নেতারা প্রচারে উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আয়ুষ্মান ভারত নিয়ে বিজেপির এটা একটা ব্যর্থতা বলা যেতে পারে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বিভিন্ন জনসভায় বলেছেন আয়ুষ্মান ভারত সবার জন্য নয়, তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। স্বাস্থ্য সাথী টাকা কোথা থেকে আসবে সেটা নিয়ে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন তুললেও অভিষেকের এই বক্তব্যের পর পাল্টা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি বিজেপির নেতারা। এর ফলে ভোট প্রচারের ময়দানে কার্যত ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে তৃণমূল।
এছাড়া ছিল গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, পেট্রোল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধি, জিএসটি নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা, করণা পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন নিয়ে অনিশ্চয়তা। এসব নিয়ে সীমিত সংখ্যক হলেও একটা অংশ মানুষের মনে দাগ কেটেছে ভোট প্রচারে। তৃণমূল কিন্তু ভোট প্রচারে তাদের কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করে সাফল্যের তাজমহল গড়েছে। কয়েকশো বিজেপি নেতা যা পারেনি মমতা সেটা করেছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না।