মৃন্ময় ভট্টাচার্য
আজ ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষ, মহা ধুমধামে পালিত হচ্ছে সর্বত্র। একজন দেশপ্রেমিক হিসাবে শুভেচ্ছা জানাই সকলকে। কিন্তু ইতিহাসের রূঢ় সত্যটা যদি জানতে চান, বলবো ১৯৪৭ সালের এই দিনটি ভারত প্রেমিকদের কাছে ছিল না কোনো আনন্দের দিন।
প্রথমত, যে সোনার পাখীকে এতদিন শিকল পড়িয়ে রাখা হয়েছিল, তাকে মুক্তি দেওয়া হলো, তার দুটি ডানা ছিঁড়ে নিয়ে, সুতরাং নামেই মুক্তি, হারিয়ে গেল নিজের ইচ্ছা মতো ও বহাল রইলো পরাধীনতা। কেন, ধৈর্য্য ধরুন, বলছি সেই করুণ কাহিনী।
সাম্প্রদায়িক কারণে দেশ ভাগ হওয়ায় জন্য, প্রায় এক কোটি লোক হঠাৎই সবকিছু হারিয়ে, গৃহহীন হয়ে গেল। দাঙ্গায় নিহত হলো কয়েক লক্ষ মানুষ, অসংখ্য নারী ধর্ষিতা হলেন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানহীন মানুষের স্রোতে নাভিশ্বাস উঠলো দুই প্রান্তের সীমান্তবর্তী অঞ্চল গুলিতে ।
আমরা জানি গান্ধীকে হত্যা করা ছিল নাথুরামের ভীষণ অন্যায়, কিন্তু এতো লক্ষ মানুষের হত্যা, ধর্ষণ ও বলপূর্বক ভিটেমাটি হারানোর জন্য দায়ী কারা, তাদের কি এই জঘন্য অপরাধের জন্য শাস্তি হয়েছিল।
এই রকম একটা বিপর্যয়ের দিন, দিল্লিতে মহানন্দে আয়োজিত হচ্ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের যজ্ঞ। দেশনেতার টুপি পড়া, ইংরেজ বন্ধু এক ব্যক্তি, বুকপকেটে একটি তাজা গোলাপ নিয়ে মধ্যরাতে হাস্যমুখে “মধ্যরাতের সূর্য উদয়” এর কাল্পনিক গল্প শোনাচ্ছিলেন উদাত্ত কন্ঠে। সত্যি সেলুকাস…….।
ব্রিটেনের পার্লামেন্টে “ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স এ্যাক্ট” নামে একটা বিল পেশ করা হয়। তখন সে দেশের বিরোধী দলনেতা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, প্রচন্ড ভারত বিদ্বেষী চার্চিল, প্রথমে এই বিলের প্রবল বিরোধীতা করেন। প্রধানমন্ত্রী এ্যটলি যখন তাকে এই বিল বৃটেনের পক্ষে কতখানি সুবিধার তা বোঝাতে সক্ষম হন, তখন চার্চিল বিলটির পক্ষে ভোট দিতে রাজি হন এবং বিলটি বিনা বাধায় পাশ হয়। নামেই বিলটি ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স বিল , আসলে ওটি ছিল ডোমিনিয়ান স্টেটাস এর নথি।
এতকাল লর্ড মাউনব্যাটেন বৃটিশ ভারতের প্রধান ছিলেন, তথাকথিত স্বাধীনতার পর ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় তিনিই “স্বাধীন” ভারতেরও সর্বোচ্চ পদে বসে পড়লেন! শুধু কি তাই, ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর তিন প্রধান রয়ে গেলেন তিন বৃটিশ, ১৯ জন বৃটিশ মেজর জেনারেলের মধ্যে রয়ে গেলেন ১৬ জন, ২৮০ জন ব্রিগেডিয়ারের মধ্যে বহাল রইলেন ২৬০ জন! ভেবে দেখুন কি গর্বের ছিল সে স্বাধীনতা! ( চন্দ্রচূড় ঘোষ ও অনুজ ধরের লেখা “কোনান্ড্রাম” বইটির 323 নাম্বার পাতা থেকে পাওয়া তথ্য।)
তবে যে সব সৈন্যরা ১৯৪৬ সালে নৌবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল, প্রধানত যাদের বিদ্রোহের কারণে ইংরেজ ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তাঁরা আর নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের জীবিত সৈন্যরা, যারা দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করতে আমরণ লড়াই করেছিলেন, তাঁদের যুদ্ধোপরাধী আক্ষ্যা দিয়ে স্থান দেওয়া হলোনা ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে। তাঁরা চরম অর্থিক দুর্দশায় বাকী জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন।
যে দেশনেতা একদা আই.সি.এস. কথাটিকে ব্যঙ্গ করে বলতেন ওটা “ইন্ডিয়ান নয়, সিভিলও নয়, সার্ভিসও নয়”। সেই তিনিই ইংরাজ দাক্ষিণ্যে গদি দখল করে সেই আমলাতন্ত্রকেও রেখে দিলেন বহাল তবিয়তে ! ক্ষমতার লোভে ডিগবাজি খাওয়া একেই বলে!
১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের গোয়েন্দা দপ্তরের শাখা “এম ফাইভ” এর দপ্তর বয়ে গেল দিল্লিতে, ভারতীয় গোয়েন্দারা দেশের গোপনীয় নথি জমা দিত M5 দপ্তরে, সেটি চলে যেত সোজা ইংল্যান্ডে!
স্বাধীন সরকার নেতাজীর ছবি সরকারি দপ্তরে টাঙানোর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ্ যদুনাথ সরকারকে বলা হলো সরকারের কথা মতো ভারতের স্বাধীনতর ইতিহাস রচনা করতে। তিনি মিথ্যা ইতিহাস লিখতে রাজি না হলে সরকারের পদলেহনকারি ঐতিহাসিকদের দিয়ে লেখানো হলো অহিংস ভাবে পাওয়া স্বাধীনতার মিথ্যা ইতিহাস। যা আজও ছাত্র ছাত্রীরা পড়ে চলেছে তাদের পাঠ্যপুস্তকে।
অনেক কটু অথচ সত্য ইতিহাসের গোপন কথা আজকের এই আনন্দময় দিনে উপস্থাপিত করলাম। যাদের খারাপ লাগলো, আমাকে অপ্রিয় সত্য বলার জন্য ক্ষমা করবেন। এসব অতীতের ভুল ভুলে, সকলে স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি পালন করুন।
জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম্।