অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
উগ্রা ভাটপাড়া গ্রামে সরস্বতী পূজা ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে বছরে দু’বার দুটি যাত্রানুষ্ঠান হয়। গ্রামের ক্লাবঘরে দুর্গাপূজায় মহিষাসুর বধ যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করার জন্য একমাস ধরে রিহার্সাল চলেছে। মহিলাদের রোল মানে অভিনয় পুরুষেরা করে। অভিনয় শিক্ষা দেন পুরামাষ্টার নামক একজন। অমূল্য রতন মণ্ডল দুর্গা, লক্ষ্মীর অভিনয়ে অবণী দাস, সরস্বতী ফটিক কোণাই, গণেশ ভাদু মিস্ত্রি, কার্তিক- কালোসোনা পরামানিক। ইঁদুর পেঁচা ময়ূর,সাপ সিংহ এগুলো গ্রামের এক একজন মুখোশ পড়ে তাদের ভূমিকা পালন করবে। যেহেতু পালার নাম মহিষাসুর বধ তাই গ্রামের মোড়লের ঐ নায়ক রোলটি তাঁর জন্য বরাদ্দ। মোড়ল মদন মোহন মণ্ডল চিরদিন চাঁদা বেশি দেন তাই তিনিই নায়ক। মহাষষ্ঠীর দিন পূজার তেমন ব্যবস্থা নেই , কেবল মাত্র ষষ্টিপূজা সন্ধ্যায় শেষ। তারপরে যাত্রা শুরু হবে।
গ্রামে ঢেড়ি পড়লো,ষষ্ঠির দিন রাত্রি ৮ ঘটিকায় যাত্রাপালা মহিষাসুর বধ। হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার! চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। গ্রামের সব বাড়ি থেকে তক্তা( চৌকি) জড়ো ক’রে মঞ্চ বেঁধে ,চারকোনে বাঁশের খুঁটিতে চারটি হ্যাচাক জ্বালানো হয়েছে। লিভু মণ্ডল বারে বারে হ্যাচাক নামিয়ে পাম্প দিচ্ছে। আশ্বিনে পোকা মাকড় ফড়িং এর আমদানি।তাই আলোর রশ্মিতে ছোট ছোট ভূতকাঠি জাতীয় গাছ হ্যাচাকে লাগিয়ে রেখেছে। অভিনয়ের সময় যেন কারো চোখে না পড়ে পোকা।ক্লাবঘরে পেন্টিং চলছে। সবার সাজ হয়ে গেছে এবার মোড়লকে কালি মাখিয়ে মহিষের মতো রঙ করা হয়েছে। তাকে চেনায় মুস্কিল,মোড়ল না মহিষ!
যাই হোক কর্নসার্ট বেজে উঠলো একজন পুরুষ নর্তকী সেজে নাচ আরম্ভ করলো। হাততালি পড়েই যাচ্ছে আর নর্তকী নেচেই চলেছে।কেউ কেউ তার বুকে সেপটিন দিয়ে টাকা বকশিস হিসেবে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। পায়ের ঘুঙুরের শব্দের সঙ্গে তক্তার শব্দ মিলে মিশে একাকার। এবার মোড়ল চিরকুট পাঠালেন প্রমটার গুরুপ্রসাদ দে মহাশয়কে, নাচ বন্ধ করার জন্য। মোড়লের তর আর সইছে না।প্রমটার পত্র পেয়েই ওদের পত্রপাঠ বিদায়ের ব্যবস্থা করলেন। যাত্রা চলছে, এবার দূর্গা দশহাতে অস্ত্র নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ। চারিদিক ঘুরে ঘুরে অভিনয় করতে করতে মঞ্চের বাঁশের খুঁটিতে লেগে নকল আটখানা হাত পড়ে গেলো। দুর্গা রোল বলতে বলতেই বললেন দুখানা হাতই যথেষ্ট বুঝলি অসুর? নকল হাত দিয়ে কি লড়াই করা যায়? মঞ্চের পড়ে থাকা হাতগুলো একজন মাথা নিচু করে নিয়ে চলে গেলো।
মহিষাসুর– আয় স্বর্গের দেবী ! সম্মুখ সমরে দেখি তোর কতো ক্ষমতা! তোকে আমি স্বর্গ দখল ক’রে অসুররাণী বানাবো। তারপরে কিগো প্রমটার? এ প্রমটার আমার পানে না তাকিয়ে খাতার পানে তাকিয়ে বলো?
প্রমটার – ব্রাকেটে আছে পদাঘাত।মানে বন্ধনীর মাঝে।
মহিষাসুর- ব্রাকেটে আছে পদাঘাত মানে তোর বন্ধনীর মাঝে পদাঘাত করি , বুঝলি দেবী দুর্গা? এবার ত্রিশুল হাতে দুর্গা আর তরোয়াল হাতে মহিষাসুরের যুদ্ধ শুরু হলো। কেউ থামতেই চায় না! প্রমটার তারস্বরে চিৎকার ক’রে বলছেন এই মোড়ল অসুর তুমি চিৎ হয়ে পড়ে যাও আর দুর্গা তোমার বুকে ত্রিশুল মারবে।
মোড়ল মহিষাসুর– হারতে আমি আসিনি, রোজ রোজ রিহার্সালে হারি ব’লে আজ হারবো না! মোড়লের মানসম্মান নাই। আমি যদি হারি তাহলে আমার বৌয়ের কাছে মুখ দেখাতে পারবো? গ্রামের সবাই বলবে অমূল্যর (দুর্গা) কাছে হেরে গেলি? এ পরাজয় আমি মানবো না।
প্রমটার চুপিচুপি গুঁড়ি গুঁড়ি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়লেন। লিভু হ্যাচাকের পাম্প খুলে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলো।বললো কেরোসিন শেষ। অগত্যা মহিষাসুর ও দুর্গা সাজঘরে ক্লাবের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়লো। এতো চিৎকার চেঁচামেচি দেখে কনসার্ট বাজতে শুরু করলো। কারন বাজনা না বাজালে তারা টাকা পয়সা পাবে না। তারা শহর থেকে হায়ার এসেছে। ওদিকে ঝগড়া এদিকে বাজনা ! মানুষ কিন্তু আসন ছাড়ছে না! যদি আবার এদের লড়াই দেখতে পায়। মোড়লের একটি কথা বারবার শোনা যাচ্ছে আমি বেশি চাঁদা দিই, আমার হারার প্রশ্নই নাই। যারা হারবে হারুক ! আমি হারুয়াপার্টি নই? এই ঝগড়ার মাঝে কে মোড়লের খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মোড়ল তারস্বরে চিৎকার করছেন সামনাসামনি আয়। কাপুরুষের মতো আমার খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিলি। ঠিক আছে এর পর থেকে আর কাউকে একছটাক চাঁদা বা সাহায্য করবো না। পূজার গুষ্টিকে বেচি আমি। এই বলেই মাটিতে পদাঘাত করতে করতে নিজগৃহে প্রবেশ করলেন।