” জন্মদিনে বিদ্যাসাগরকে পড়ে মনে”
রম্যরচনা
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ভগবতী দেবী উচ্চ বিদ্যালয়ে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম জয়ন্তী পালিত হচ্ছে। আগে এটা হুগলী জেলার অন্তর্গত ছিল। এলাকার ছাত্র ছাত্রী অভিভাবকগণ ও সাধারণ মানুষের ভীড়ে বাইরে শ্রোতাদের জন্য মাইক লাগানো হয়েছে। বিদ্যালয়ের হল ঘর উপচে মাঠের আনাচে কানাচে লোকের জনসমাগম। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করছেন বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট এলাকার মোড়ল নন্দ কুমার জানা মহাশয়। তিনি বিদ্যাসাগরের অবয়ব মূর্তিতে মালা পরিয়ে বললেন — এ কেমন ধারা গলায় মালা দিলাম কিন্তু বিদ্যাসাগরের পা নেই, শুধুমাত্র মুখখানা।পাশপোর্ট ছবির মতো। কিভাবে যে উনাকে প্রনাম জানাবো বলুন তো? তিনি বললেন ঠিক আছে পন্থা বের করছি বিদ্যাসাগরের মাথা আর আমার চরণ মিলে একটা রূপ দিলাম,এই বলেই নিজের দুই পা ছুঁয়ে সামনের সারিতে বসা সকলের মাথায় চরণধূলি দিয়ে হাত ঝেড়ে সবার উদ্দেশ্যে প্রণাম ছিটিয়ে দিলেন। বললেন আপনাদের কষ্ট হবে তাই আমার পদধূলি উড়িয়ে দিলাম। এতেই সবার বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানানো হলো।
এইবার ভাষন শুরু করলেন – বিদ্যাসাগর মশাই মাথামোটা কই মাছের মত দেখতে। মাথা মোটাদের বুদ্ধি বেশি হয়। আমার ছেলে শ্রী মান গোপাল জানা প্রায়ই বলে মাষ্টারমশায়গন আমাকে শুধু মাথা মোটা বলেন ! আমি আমার সন্তানকে বললাম , তুমি ক্লাসে বেশি বুদ্ধিমান তাই উনারা বলেন। দেখতে হবে এটা কার ছেলে বটে? বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় লিখে বর্নের সঙ্গে পরিচয় ঘটালেন। তারপরে আর উচ্চ শিক্ষার কি প্রয়োজন ? সঙ্গীতের সা রে গা মা পা শিখলেই গান গাওয়া যায়। তাহলে আর শুধুমাত্র বছর নষ্ট করে একই অ আ দিয়ে লেখাপড়া করার কি দরকার? খাতায় নাম থাকলেই সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো সিঁড়ি বেয়ে ম্যাট্রিক পাশ। সবাই যদি লেখাপড়া শেখে তাহলে আমাদের মত মোড়লের কি অবস্থা হয় বলুন তো? রাখাল,চাষী, কৃষান ,ঝি,চাকর আর পাওয়া যাবে? মোড়লদের কি মাঠে গরু চড়ানো শোভনীয়? না কাজ করা শোভনীয়।কথায় আছে না – যার কাজ তারি সাজে ,অন্য লোকের লাঠি বাজে! “রাখাল বড়ো সুবোধ বালক” আমরা পড়েছি এবং সেটা কার্যে প্রয়োগ করেছি। সত্যিই তো তারা চুপচাপ কাজ করে যায়। আমরা খাওয়া দাওয়া করে অবশিষ্ট নষ্ট খাবার ওদের দিই , কিছুই বলে না ওরা। ভাত হলো লক্ষ্মী,এ নষ্ট করতে নেই। আমাদের ছেলে মেয়ে যখন খেতে পারে না তখন ওরা দিব্যি সুন্দর সেটা খেয়ে নেয়। গোগ্রাসে গিলে গিলে খায়।জঠর জ্বালা বড়ো জ্বালা। আগে পেট তারপর স্কুল। ঠিক কিনা?
জীবদ্দশায় বিদ্যাসাগরের জন্মদিন হয়েছে কিনা আমার জানা নাই । যিনি যতো কষ্টে মারা যাবেন তার জন্মদিন তত সমারোহে পালন করা হয় এটা জানি। যেমন ক্ষুদিরাম! আহা রে! বেচারা গলায় দড়ি দিয়ে ছটপট করে মারা গেল।তার নামে গান সারা বাঙলাতে ছড়িয়ে পড়লো। তাকে আমরা শহীদ বলি। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দেশ ছাড়া হয়ে হারাধন হলো! এই হারাধনের জন্য জন্মদিন পালন করি। মৃত্যু খবর ভগা নঃ জানন্তি! কদম কদম বাড়ায়ে যা — এই ভাবেই তো আমরা একপা একপা ক’রে এগিয়ে চলি।
তবে এমন সর্বনাশা বিদ্যাসাগর মাথামোটার বুদ্ধি দেখে মানুষ হতবাক্! বিধবা বিবাহ, নিয়ে পড়লেন ঝাঁপিয়ে , এতো অনাসৃষ্টি সহ্য হয়। শাঁখা সিঁদুর মালাবদল কি বার বার হয়? জন্ম মৃত্যু বিয়ে – বিধাতার দিয়ে। এই প্রবাদ বাক্য তিনি ভুলে গেলেন ! বয়সকালে ভীমরতি ধরলো! বিধবা মানুষ ধর্মকম্মে ঈশ্বরে মতি নিয়ে বাঁচবে — তা নয় আবার সাতপাক। পাক খেতে খেতে মাথা ঘুরে যাবে না ? নিজের ছেলের সাথে এক বিধবার বিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধ নয় শান্তি এ শ্লোগান তিনি জানেন না! প্রাণপণে বাঁচতে ছুটে পগারপার। আর এমুখো জীবনে হননি ।একেবারে ভিন্ দেশে ঝাড়খণ্ডের কর্মাটারে সাঁওতাল পল্লীতে বসবাস করতে লাগলেন। জীবনের শেষ টুকুও শান্তি জুটলো না। সুকুমার রায়ের কবিতার কথা মনে পড়ে গেল- বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাইয়ের ষোলো আনা জীবনটায় বৃথা। নমস্কার আর আমি বলবো না।এই বলেই বক্তব্য শেষ করছি। হাততালি দিন হাততালি! এই বলেই নিজেই হাততালি দিতে লাগলেন। তারপর সবার হাততালিতে হলঘর ফেটে পড়লো। মোড়ল হাসিমুখে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
শুভ জন্মদিনে বিদ্যাসাগর
দীননাথ চক্রবর্তী
সাগর ভাষা মাইলস্টোন
মুড়ি মুড়কি রাইমণি ,
প্রান্তমুখ কার্মাটার
প্রেসিডেন্সি যুগধ্বনি।
দামোদর ভগবতী ,
ঠাকুরদাস সরণী ,
বাদুরবাগান কোলকাতা
মধুসূদন সৃজনী।
সেই ভাষাতে মাথা তোলে
ভাষার চারা মাটির ,
দিনে দিনে মহিরুহ
দেশ সমাজ জাতির।
দিনে দিনে আগামীর
ফুলে ফলে ঋদ্ধ ,
সাগর ভাষা মহিরুহ
কল্পতরু সিদ্ধ ।