মা
দীননাথ চক্রবর্তী
মাগো তুমি কোথায়?
একটা কথা বলবো
চুপিচুপি
কানেকানে।
নাহলে ঠাট্টা করবে সকলে
ঘর পাড়া
বলবে আদিখ্যেতা।
সে বড় লজ্জার মা
কেননা
সে কথার সবটা জুড়েই যে তুমি
আমিতো জানি
তুমি এসেছো
কাশ শিউলির সঙ্গে সঙ্গে
জগৎ জননী পরিবারের পায়ে পায়ে
বড় বেশী বেশী করে ।
আমার ঘরের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে
তোমার গায়ের গন্ধ
সিঁড়ি ভাঙা পায়ের শব্দে শব্দে
শিউলি কবিতা
জানালা দরজার পর্দায় পর্দায়
তোমার গা ময় অগুরু চন্দন
জুড়িয়ে যায় মন প্রাণ।
তুমিতো এসেছো আজ
এতদিন ছেড়ে থাকতে পারলে?
জানো মা
দানোয় পাওয়া বাড়িটা আবার
উদাসী বাউলের একতারার মতো
বেজে উঠেছে ।
সে সুরের কথায় কথায়
কদিনের পূজার ব্যঞ্জনার স্বাদ
ভোগের খিচুড়ি
কতদিন যেন খাইনি ।
পায়ে পায়ে তোমার সেই ব্যস্ততা
কপালে ঘামে লেপ্টে থাকা চুল
হাতে নোয়া পলার যুগলবন্দী ।
মাগো একবার আসবে
একটা কথা বলবো
চুপিচুপি
কানেকানে
আসোনা মা।
ছোট গল্প: পূজা আসছে……….,
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ!
পূজা আসছে, চারিদিকে কর্মযজ্ঞ চলছে। কোথাও প্যাণ্ডেল বাঁধা,কোথাও কারুকার্যের নক্সা, কোথাও বাজি ফাটানোর তোড়জোড়।গোটা বাঙালি জাতি এই নিয়ে তোলপাড়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পোশাকের বায়না। কারো পৌষমাস আবার কারো সর্বনাশ। গরীব হতভাগা মানুষ তাঁরা প্যান্ডেল বানায়,প্রতিমা বানায়, প্রতিমা ঘাড়ে ক’রে মণ্ডপে আনে আবার বিসর্জন তারায় করে। এসবে অনেক অনেক অর্থের অপচয়। দেবীর প্রতিমার দাম নগন্য কিন্তু প্যাণ্ডেল আলোর রোশনাই, বাজি ফটকা এতে যা খরচ হয় তাতে অনেক গরীব হতভাগা মানুষকে বস্ত্র বিতরণ করা যায়। ছেঁড়া ফাটা বস্ত্র পরিধান করে গরীবের ছেলে মেয়েরা লজ্জায় বেরুতে পারে না।আলোর জ্যোতি যখন তাদের শরীরে পড়ে তখন কঙ্কালসার দেহের আবরন উন্মোচন হয়ে যায়। একদিকে পাল্লা দিয়ে পূজার বাজেট বেড়েই চলেছে, তখন অন্যদিকে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে ভিক্ষাবৃত্তি স্থান পাচ্ছে।
এমনিই এক সংসারের কথা আজ বলছি—!
চরগোপালপুর গ্রামের শেষে গরীবের বাস। শহরের কাছাকাছি হওয়ায় বেশীরভাগ মেয়েরা এখান থেকে শহরে কাজের মাসি হিসেবে দৈনন্দিন কাজ করে।
মন্মথ দাস ও তার স্ত্রী সম্মানীর পাঁচটি মেয়ে।পুত্র সন্তানের আশায় এতগুলো মেয়ের জন্ম হয়েছে। খড়ের ছাউনি ঘর একটি ও বারান্দা আছে। বারান্দায় আবার হাঁসের ঘর। সেখানে হাঁস থাকে,তার পাশে একটি ছাগল থাকে ও ওর মধ্যেই রান্না হয় উনুনে একবেলা। মন্মথর ছোট মেয়ে পূজা,বয়স তেরো চোদ্দ হবে।সেও শহরে কাজ করে পাঁচ বাড়ীতে। অন্য চার মেয়ের শহরেই বিয়ে হয়েছে,কাজ করতে করতেই ভালোবেসে। পূজা পূজার বোনাস হিসেবে বাড়তি একমাসের মাহিনা পায়। ওতেই বাবা মায়ের ও নিজের পরিধানের ব্যবস্থা হয়। অষ্টমীর সন্ধিপূজার জন্য উপোষ রেখে পূজা দিতে গেছে শহরের সার্বজনীন পূজা মণ্ডপে। খুব ধূমধামের সঙ্গে বাজনা বাজছে সন্ধিপূজার। এখানে পাঁঠাবলি হয়না। পূজা শেষ হতে হতেই ভোর তিনটে। পূজার সঙ্গী নেই কেউ।প্রসাদের থালা নিয়ে একহাতে শহরের আলো শেষে, গ্রামের আলোআঁধারি পথে বাড়ীর দিকে এগিয়ে আসছে। কাশবনের জঙ্গলে ওৎ পেতে বসেছিল ওই পূজা মণ্ডপে দেখা কয়েকজন বড়োলোকের ছেলে। পূজার গতিবিধি লক্ষ্য করছিল তারা সর্বক্ষণ। সকলেই মদের নেশায় মদমত্ত। পূজা আসতেই সবাই ওকে চেপে ধরলো। চিৎকার করার আগেই মুখ চেপে ধরলো।হাতের থালার প্রসাদ মাটিতে পড়ে তাদের পায়ে পদদলিত হলো। উপোষী পূজা তাকে ভক্ষণ করলো একে একে সবে। সারাদিন না খাওয়া পূজা এলিয়ে পড়লো। লড়াই করতে পারলো না।নরম মাংসে পশুদের লালসা মিটলো। পূজার গোঙানিতে শুধুমাত্র জল জল শব্দ বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ গ্রামের মেয়েরা জ্বালানি সংগ্রহ করতে এসে দেখে পূজার এই অবস্থা,আর দেখে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে অসুরেরা। জ্বালানি কাটার হাঁসুয়া হাতে নিয়ে অসুরদের সামনে হাজির। ওদের হাঁসুয়া দেখে নেশা ছুটে গেছে। গ্রামের মেয়েদের এলোপাতাড়ি কোপে সব অসুরের নিধন হলো। পূজাকে সকলে পাঁজা কোলা করে সেবা করে তার বাড়ীতে ফিরিয়ে দিয়ে এলো। পূজার আর প্রসাদ চায়না! সে পেটের ভেতরের খাদ্য বস্তু বমি করে বের করে দিলো। নোংরা অপবিত্র শরীর নিয়ে সে বাঁচতে চাই না! হঠাৎ মূর্ছা গেলে দেবী দুর্গা তাকে বললো হতভাগী তুই পবিত্র। গঙ্গা জলে কতো নোংরা ভেসে যায়। আবার পূজা হয় ঐ জলে। দানবেরা তোর ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে অত্যাচার করেছে! আজ থেকে আমি তোর শরীরে বিরাজ করবো। আমার ত্রিশুল এবার তোর হাতে থাকবে। পূজা আবার শুরু হলো। মন্দিরে মন্দিরে মায়ের আসনে চরগোপালপুরের পূজা খর্গহস্তে দণ্ডায়মান।
“কলমের আঙিনা”
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
সাহিত্যের কুঁড়ি মাঝে মন বিচরণে,
সর্বস্ব বিলিয়ে শ্রদ্ধা দেবীর চরণে,
আসনে কলম যোগ বাগ্দেবী স্মরণে,
অভক্তির অপমান পীড়া জাগে মনে।
মৌমাছি,ভ্রমর ব্যস্ত মধু আহরণে,
রচনা খাদ্যফসল রুচি নিজ গুণে,
রসনা তৃপ্তি মেটে কি মিষ্টান্ন বিহনে!
সঙ্গীত মধুর নয় বাদ্যযন্ত্র বিনে।
দায়বদ্ধতা সমাজে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে,
আপোষহীন সংগ্রাম ভরণপোষণে,
মেরুদণ্ড সোজা রেখে মিথ্যা বানী হানে,
প্রতিবাদী জনস্রোতে কলম শ্লোগানে।
কলমের লাল খোঁচা বিচারে আইনে,
বাহুবলী কুপোকাত ভুক্তভোগী জানে।
“মহালয়া”
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
বেতারের অনুষ্ঠানে মহিষাসুরমর্দিনী,
পতি রান্না ঘরে ব্যস্ত চা চান সহধর্মিণী।
নজরে ত্রিশুল হাতে নাম তার ত্রিনয়নী,
বধূ নির্যাতন ভয় কেস দেবে মানহানি।
কর্তা তাই সেবা করে তার চরণ দুখানি,
লজ্জা শরম বাঁদিকে পর্দার আড়াল টানি।
দিবস রজনী কাটে স্ত্রীয়ের চোখ রাঙানি,
থলে হাতে কেনা কাটা মস্তকে বাজারখানি।
স্ত্রীর পছন্দ তালিকা খাদ্য বস্ত্র আমদানি,
কটূকথার বন্যায় সদা নাকানিচুবানি।
বধূর নালিশ কোর্টে রক্ষা কবজ আইনি,
পতি নির্যাতন কেস্ রায় বানানো কাহিনী।
দশহাতে অস্ত্র দিয়ে বানিয়েছে রাজরানী,
দেবতারা বোকা বটে! নাও ঠ্যালা হয়রানি।
অবলা নারী সবলা বাংলায় সবাই জানি,
ঠ্যালার নাম বাবাজি ভুল মন্ত্রপাঠ হানি।
কুমারী পূজা আসনে চিরকুমারী যে তিনি,
রাষ্ট্রপুঞ্জে গুঞ্জরণ দেবী অসুর বাহিনী।
“স্বর্গে হাহাকার”
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
স্বর্গরাজ্যে কাজ নেই সবাই বেকার,
শিব পড়েছে ফাঁপড়ে কিভাবে উদ্ধার,
বিশ্বকর্মা ফিরে স্বর্গে করেছে প্রচার,
বাংলায় কাজের খনি শিল্পের বাজার।
ডমরু বাজায়ে শিব মর্ত্য দরবারে,
মানুষের ভিড় জমে শিবের সংসারে,
গণেশ ঘুগনি বেচে দুর্গা ঘোরে ফেরে,
তেলেভাজার দোকান লক্ষ্মী হাঁক ছাড়ে।
কার্ত্তিক মশালা মুড়ি সবার নজরে,
সরস্বতী বই ছিঁড়ে ঠোঙা তৈরি করে,
কচুরিপানায় থালা শিল্পের বিচারে,
কাশফুলে লেপ কাঁথা বাংলা কিনা পারে!
বেকারের সমাধানে রানী শিল্পে খ্যাত,
ঘোমটা ফেলে খ্যামটা মিথ্যা বংশজাত।
ইচ্ছা
মৃন্ময় ভট্টাচার্য
ইচ্ছা করে এই দুর্গোৎসব
পুজো হয়ে উঠুক আবার,
হুল্লোড় নয় ভক্তি ফিরুক
পাপ মরুক মনে সবার।
যাঁর জন্য এই আয়োজন
তাঁর পুজোটা নমোঃ নমোঃ
পেট পুজোতে মদ মাংস
সাজ পোশাক চোখ ধাঁধানো।
বাজছে মাইক তারস্বরে
আলোর ঝলক্ চকমকিয়ে,
এক কোণেতে পূজ্য দেবী
একলা পরে মুখ লুকিয়ে।
তাঁর বদলে থিমের নামে
রাক্ষসী এক দুর্গা সেজে,
মনোরঞ্জন করছে সবার
লজ্জিত মা নয়ন বোজে।
ভন্ডামি সব থামবে কবে
কবে বাঙালি মানুষ হবে!
মা আসবেন হাস্য মুখে
আশীর্বাদই লক্ষ্য হবে।
মুছতে পারিনি
মৃন্ময় ভট্টাচার্য
সবার ফোনের স্মৃতিতে থাকে
কতো দরকারি নাম,
অনেক প্রিয়, আত্মীয় আর
কাজের প্রতিষ্ঠান
এককালে যা ছিল দরকারি
আজ তা মূল্যহীন,
ফোনের স্মৃতিতে উজ্বল তারা
মনের স্মৃতিতে ক্ষীণ।
স্মৃতি ভান্ডার করতে খালি
মুছতে অ দরকারি,
চমকে দেখি মৃত মানুষের
নাম লেখা সারিসারি!
প্রিয় বন্ধুর নাম কেমনে মুছি
মৃত দাদাও তাই!
ভালোবাসা তো এখনও বেঁচে
মুছতে পারিনি ভাই ।
“উমার আগমন”
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
মা উমা আসছেন স্বর্গ থেকে নরকের পথে!
আর এখানের উমা জঠরে সন্তান নিয়ে দশমাস দশদিন আগলে,প্রসব যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে মা ডাক শুনে তৃপ্তি পায়।
সব দুঃখ যন্ত্রনা ভুলে যায় তার নবজাতককে পেয়ে। সন্তানকে বড়ো করে পথে পথে ঘুরে খাওয়ায়, বাবা বাছাধন খাও খাও ক’রে নয়নের জল মুছে ! আজ সেই উমা খাবারের জন্য পথে পথে ঘুরে দাও দাও ক’রে নয়নের জল কাপড়ের আঁচলে মুছে।
সন্তান বের করে দিয়েছে তারে, সে আজ পথের ভিখারি, স্বামী ভিটে ছেড়ে।
এখানে উমার প্রতিমায়,কতো নৈবেদ্য ডালা ভ’রে! পুষ্পাঞ্জলি প্রতিমার উদ্দেশ্যে, পুত্রসন্তানের মুখ চেয়ে আরাধনা। আগমনে নাচন কোদন, আবার বিসর্জনে মদমত্ত ডিজে বাজনা নিয়ে। মায়ের চ’লে যাওয়ার ব্যথা জাগেনা অন্তরে।
নরকপুরীতে এ রকম পূজার্চ্চনা দেখেন দেবী উমা মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে!
চোর, ডাকাত, বাহুবলী আঁতাত, প্রতিমার আবরণ উন্মোচনে ফিতা কাটে! মানুষ কানকাটা বেহায়া বলে ডাকে তাঁরে। তবে আড়ালে আবডালে গোপনে চুপিসারে।
কতো উমা ঘুরে বেড়ায় থালা হাতে খাদ্যসন্ধানে আস্তাকুঁড়ে!
পাঁকে জন্মে পঙ্কজ! সে দামী প্রতিমার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয়,পড়ে তাঁর পদতলে !
এখানে চুরি ক’রে ধনী, হোন্ রাজা,মন্ত্রী, রানী, অবৈধ স্ত্রী সন্তানের জনক জননী।
তাঁদের লক্ষ্য একমাত্র খনি। গর্ভধারিনী মা ছেড়ে শাশুড়ি আমদানি।
সারা জনমে দেয়নি মাকে কোনোদিন মুখে মিষ্টি, মৃতের পরে প্রতিযোগিতা শুরু , বেনাগাছে মিষ্টি, ভূড়িভোজে মিষ্টি, পাড়াপড়শি খেয়ে ধন্য ধন্য রব — ছেলের পড়েনা মনে মায়ের মুখখানি।
সারদা মা
দীননাথ চক্রবর্তী
গঙ্গাস্নানে যায়না ময়লা মন্ত্রে মায়ের বন্দনা ,
লক্ষ জপে হয়না মগন ধ্যানে ধ্যানে সাধনা ।
কামনা তোর জিদ্দে জ্যাঠা মনের ময়লা বসন ,
শিখেনে মন মায়ের কাছে ভজন ঝাঁটা গড়ন।
সেই ঝাঁটাতে ঝাঁট দেরে মন সকাল সন্ধ্যে অন্তরে ,
মন্দির তোর দেহখানি বিবেক বোধন মর্মরে।
সময় থাকতে নেরে শিখে মায়ের কাছে ঝাঁটানো ,
আর দেরী নয় নয়রে ওরে সময় মায়ের শেখানো।
“বারোমাস্যা”
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
বৈশাখে প্রথম দিনে লাড্ডু গণেশ পূজনে,
বছরের হলো শুরু,
জৈষ্ঠ্যতে জামাইষষ্ঠী হরেক রকম মিষ্টি,
গুষ্টি চুলকায় ভুরু।
আষাঢ়ের রথযাত্রা পুরীতে ভীড় বেমাত্রা,
সমুদ্র সৈকতে পাড়ি,
শ্রাবনে ঝুলনযাত্রা কৃষ্ণের খুশির মাত্রা,
রাজা নিকুঞ্জ বিহারী।
ভাদ্রমাসে নন্দোৎসব সঙ্গে বেড়া ভাসা,
ভাদুপূজা ভাদুগানে,
আশ্বিনের দুর্গোৎসব বাঙালির মহোৎসব,
সম্প্রীতি বাহু বন্ধনে।
কালীপূজো ভাইফোঁটা কার্ত্তিকের মাসে,
অগ্রহায়নে নবান্ন,
পৌষ মাসে পিঠেপুলি লক্ষ্মী ঘরে আসে,
শৈত্যপ্রবাহ আসন্ন।
বাগ্দেবীর আবাহন মাঘেতে কলাইসেদ্ধ,
লেখাপড়া হাতেখড়ি,
ফাল্গুনে দোল পূর্ণিমা রঙের নানা ভঙ্গিমা,
কৃষ্ণচূড়া পলাশেরি।
চৈত্র মাসের গাজন চড়ক পূজোর মেলা,
রাখাল অশ্বত্থ তলে,
তপ্ত দাহনে যন্ত্রণা খালবিল জলশূন্য,
মরুভূমির কবলে।