পিন্টু সান্যাল
ভারতবর্ষের ইতিহাসের ব্যাপকতা ও বিভিন্ন কারণে এর বিশিষ্টতা তার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের সুযোগ এনে দেয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস যেমন প্রাচীন, তেমন ঘটনাবহুল। ভারতবর্ষ পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা। বেদ-উপনিষদ এর প্রাচীনতম সাহিত্য। বেদ-উপনিষদকে পশ্চিম বিশ্ব ‘ইতিহাস’ বলে স্বীকার না করলেও ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে স্বীকার করেছে। ‘ইতিহাস’ রচনার ক্ষেত্রেও ভারতবর্ষের নিজস্বতা আছে। প্রত্যেক ঘটনা শ্লোকের আকারে লিপিবদ্ধ করার সময় ; সেসময়ের চন্দ্র-সূর্য , গ্ৰহ-নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। যা থেকে একদিকে যেমন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতা সম্পর্কে জানা যায় , অন্যদিকে ঘটনাগুলোর কালনির্ণয়ে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে আসা যায়। সুতরাং , কালনির্ণয়; ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে সভ্যতা যত আগে কালনির্ণয়ের পদ্ধতি ও লিপির ব্যবহার শিখেছে, সেই সভ্যতা তাদের ইতিহাস তত আগে থেকে লিপিবদ্ধ করেছে। কাল নির্ণয় ও লিপির ব্যবহার তাই ‘সভ্যতা’র প্রাথমিক শর্ত হয়ে দাঁড়ায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার ‘কালনির্ণয়’ এর ইতিহাস, স্বতন্ত্রভাবে সেই সভ্যতার বিজ্ঞানের ইতিহাস। সেই সভ্যতার প্রাচীনত্বের প্রমাণ। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপের বর্তমান অগ্ৰগতি, ইউরোপের ‘কালনির্ণয়’ এর ইতিহাস জানতে আমাদের আগ্ৰহের উদ্রেক করে। অন্যান্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতো এই ক্ষেত্রেও ভারতের অবদান কি তা আমাদের জানা প্রয়োজন।
আমাদের জন্মদিন, আমাদের প্রত্যেকের কাছে খুব প্রয়োজনীয়। আমাদের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আজ যদি প্রশ্ন করা হয় , আপনার জন্মদিনের যে তারিখটি আপনি ব্যবহার করেন সেটি কি ঠিক ? সেই তারিখ যে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঠিক করা হয় , তার কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে ?
আমরা সাল, তারিখ উল্লেখ করি খ্রীষ্টাব্দ বলে অর্থাৎ যে কোনো ঘটনার তারিখ নির্ধারণ হয় যীশু খ্রীষ্টের জন্মের সময়কে একটি নির্দিষ্ট দিন ধরে নিয়ে।
কিন্তু যীশুর জন্ম দিনটি কি নির্দিষ্ট ? তার কি কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে ? যীশুর জন্মদিন ষষ্ঠ শতাব্দীতে ঠিক করা হয়েছে। অর্থাৎ তার তথাকথিত জন্মদিনের ছয়শত বছর পরে। যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বিশ্বের কাছে এখনও অজানা! ইংরেজিতে সাল উল্লেখ করতে AD বা BC দেওয়া হয় , যেমন 2020 AD । AD অর্থাৎ Anno Domini যার অর্থ Year of Lord। এইখানে ‘Lord’ কে ?
যারা ‘সেক্যুলারিজম্’ এর প্রবক্তা তাদের কাছে প্রশ্ন তারিখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কেনো কোনো একটি উপাসনা-পদ্ধতি কে অগ্ৰাধিকার দেওয়া হবে?
ভারতবর্ষের কাল নির্ণয়ের কোনো নিজস্ব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কি নেই ? ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের সভ্যতা কি নিজস্ব কোনো কালপঞ্জি ছাড়াই বিকশিত হয়েছিল ?
আসলে , আমরা যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা আমাদের স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিকতার(Colonization) সবথেকে বড় প্রমাণ । অন্যদিকে ভারতীয় কালগননা পদ্ধতি একইসাথে ভারতবর্ষের প্রাচীন বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতা ও ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের ইউরোপে স্থানান্তরণ বা আরো স্পষ্ট করে বললে চৌর্যবৃত্তির এক অকাট্য প্রমাণ।
আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে যে ক্যালেন্ডার আছে তাকে গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বলা হয় পোপ গ্ৰেগরির এর নামানুসারে।
গ্ৰিক ঐতিহাসিক হেরোডেটাস এর মতে গ্ৰিকরা তাদের ক্যালেন্ডার মিশরীয়দের থেকে অনুকরণ করেছিলো। কিন্তু গ্ৰিক ও রোমানরা উভয়েই সেই নকল করা ক্যালেন্ডার কে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারে নি ।কারণ তাদের পাটীগণিতে অজ্ঞানতা।
গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৪৮ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার মিশর দখল করেন এবং মিশরীয় জ্যোতির্বিদ সসিজিনিস(Sosigenes)এর সহায়তায় ৪৬ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে অনেক ধোঁয়াশা নিয়েও ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন।
সংশোধিত ক্যালেন্ডার কে পৃথিবীর জলবিষুব বা মহাবিষুব(equinox)এর সাথে মেলাতে গিয়ে ৪৪৫ দিনের হেরফের হচ্ছিল।
মিশরীয়রা , রোমানদের পাটীগণিত এর অজ্ঞানতা সম্পর্কে জানতো এবং বুঝতে পেরেছিল যে রোমানরা মাসের হিসেব কে চাঁদের বিভিন্ন দশার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারবে না সেইজন্য তারা রোমানদের একটি সহজ ক্যালেন্ডার দিয়েছিল যাতে মাসের সঙ্গে চাঁদের দশার কোনো সম্পর্ক ছিল না।সসিজিনিস এর ক্যালেন্ডারের ৭ মাসের দিনসংখ্যা ৩০ ও অন্য ৫ মাসের দিনসংখ্যা ৩১ রাখা হয়েছিল যেখানে প্রত্যেক ৪ বছর পর একটি লিপ ইয়ারের কথা বলা হয়।
রোমানরা এই ক্যালেন্ডারের কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দখলে নিয়ে জুলিয়াস এর নামে এই ক্যালেন্ডারের নামকরণ করে এবং একটি মাসের নাম জুলাই রাখা হয়। কিন্তু তারা সসিজিনিস এর সাধারণ নির্দেশ বুঝতে না পেরে ৩ বছর পর পর লিপ ইয়ার যুক্ত করতে থাকে।
এই ভুল অগাস্টাস(Augustus) এর সময় ঠিক হয় এবং তার জোরাজুরিতে একটি মাসের নাম অগাষ্ট (August) তার নামানুসারে রাখা হয়।
জুলিয়াস কে অনুসরণ করে তিনিও অগাষ্ট এর দিনসংখ্যা ৩১ করে দিলেন।
জুলাই ও অগাষ্ট এর এই অতিরিক্ত দুইদিন ফেব্রুয়ারি থেকে কাটা হলো।রোমান ক্যালেন্ডারে বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা হলো ২৮ , ২৯ ,৩০ এবং ৩১ যার সঙ্গে চাঁদের দশার কোনো সম্পর্ক নেই এবং কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই।এর থেকেই কি গ্ৰিক ও রোমানদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে অজ্ঞতা প্রমাণ হয় না ?
কারণ তারা চাঁদের বিভিন্ন দশার হিসেব রাখতেই জানতো না।
এমনকি রোমানরা সূর্যের ঋতুচক্রের হিসেব রাখতেও জানতো না।
চার বছর পর লিপ ইয়ারের হিসেব অনুযায়ী প্রত্যেক বছর হয় ৩৬৫ ১/৪ দিনে।এটা আদৌ ঠিক নয় যদিও এখনো আমাদের এটাই শেখানো হয়।
দুই জলবিষুব(Autumnal equinox , 22-23 September ) বা মহাবিষুব(Vernal equinox,20-21 March) এর মধ্যের সময় কে ট্রপিক্যাল বছর (Tropical year) বলা হয় এবং এর সময়কাল ৩৬৫.২৪২ দিন , ৩৬৫.২৫ দিন নয়।
তাহলে গ্ৰিক ও পরে রোমানরা কেনো এটিকে ভুল করে ৩৬৫.২৫ দিন করলো?
আসলে , রোমানরা ৩৬৫.২৪২ এর মতো একটি সংখ্যা কে লিখতেই জানতো না কারণ তারা ০.২৪২ এর মতো নিখুঁত ভগ্নাংশ লিখতে পারতো না।
রোমানরা কেবলমাত্র ১২ এর ভগ্নাংশ পর্যন্ত লিখতে পারতো যেমন ১/১২ ,২/১২,৩/১২ ইত্যাদি।
সেইজন্য তারা ৩৬৫.২৫ কেই বছরের দিনসংখ্যা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
৪র্থ শতাব্দীতে চার্চ (Nicene Council) ইস্টার(Easter) এর দিন নির্ণয়ের জন্য জুলিয়ান ক্যালেন্ডার কে নিজেদের উপাসনা সম্পর্কিত কাজের জন্য ব্যবহারের স্বীকৃতি দেয়।তখন খ্রিস্টানদের প্রধান উৎসব ছিল ইস্টার।তখন থেকেই মিশরীয়দের থেকে পাওয়া ক্যালেন্ডার , জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে খ্রীষ্টানদের ক্যালেন্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ।
চার্চের নির্দেশানুযায়ী মহাবিষুব (Vernal equinox) এর পর ; প্রথম পূর্ণিমার(Full moon)পর , প্রথম রবিবার ইস্টার হিসেবে ধার্য করা হলো।
যদি সেইদিন ইহুদীদের উপাসনার অনুষ্ঠান পাসওভার(Passover)এর সঙ্গে মিলে যায় , তাহলে ইস্টার পরের রবিবারে স্থানান্তরিত হবে।
তাই ইস্টারের দিন ধার্য করতে মহাবিষুব ও চাঁদের দশা সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন হয়ে পড়লো।
রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি ১ বছরে মহাবিষুব বা জলবিষুব এর দিন ০.১ দিন করে পিছিয়ে যেতে থাকে অর্থাৎ ১০০ বছরে ১ দিন।
তাই এক শতাব্দীতে ইস্টার ১ দিন করে সরে যেতে লাগলো।
এইজন্যই পোপ হিলারিয়াস ৫ম শতাব্দীতে ক্যালেন্ডার সংশোধনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিফল হলেন।এই বিফলতা জ্যোতির্বিজ্ঞানে(Astronomy) এবং গণিতে রোমানদের অজ্ঞানতাই প্রমাণ করে।
যদি সেইসময় বহু চর্চিত গ্ৰিকদের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর আকর গ্ৰন্থ Almagest (বলা হয়ে থাকে ২য় শতাব্দীতে Claudius Ptolemy দ্বারা রচিত )এর অস্তিত্ব আদৌ থাকতো , তাহলে
৫ম শতাব্দীতে এই ক্যালেন্ডার সংশোধনের কাজে কেনো ব্যবহার করা হয় নি তা একটি বড় প্রশ্ন।তাই গ্ৰিকদের জ্যোতির্বিজ্ঞান(Astronomy) এ দক্ষতার কল্পকাহিনীকে এই ঘটনা মিথ্যা প্রমাণ করে।
অন্যদিকে ভারতবর্ষে যে কোনো ভগ্নাংশ লেখার সঠিক পদ্ধতি ছিল।
ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই ,নক্ষত্র বর্ষ (Sidereal year )এর দিন সংখ্যা সুনির্দিষ্ট ভগ্নাংশের সাহায্যে ৫ম শতাব্দীতে আর্যভটের গিতীকা(Gitika 3) তে উল্লেখ করা হয়েছে।নক্ষত্র বর্ষের(Sidereal Year) এর দিন সংখ্যা আর্যভট বলেছিলেন ৩৬৫.২৫৮৬ ।নক্ষত্র বর্ষের বর্তমানে গৃহীত দিনসংখ্যা ৩৬৫.২৫৬৩।
আর্যভটের গণনা দশমিকের পর দুই ঘর পর্যন্ত সঠিক ছিল।
মনে রাখতে হবে এটি নক্ষত্র বর্ষ ( Sidereal Year) এর দিনসংখ্যা যা ক্রান্তীয় বছর(Tropical year)(৩৬৫.২৫)এর থেকে বেশী।
তাই ক্যালেন্ডার বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করে যে , গ্ৰিক ও রোমানদের তুলনায় ভারতবর্ষ গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে ছিল।
গ্ৰিকদের বিজ্ঞানের কৃতিত্বের সমস্ত গল্প দ্বাদশ শতাব্দীর পরের বিভিন্ন পুঁথির উপর প্রতিষ্ঠিত যা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
পশ্চিম বিশ্বের গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান এর এই অজ্ঞানতা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রুসেড এর পর থেকে তারা অন্যদেশ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করতে শুরু করে।
ভারতীয় গণিতের জ্ঞান দশম শতাব্দীতে আরবের আল খোয়ারিজ্মি(Khwarizmi) এর অনূদিত হিসাব-এ-হিন্দ্ (Hisab al Hind) এর মাধ্যমে আরবে পৌঁছায়।
পশ্চিম বিশ্ব রোমান অঙ্ক(Numeral) এর পরিবর্তে আরবের মাধ্যমে ভারতীয় অঙ্ক (Arabic numerals ) গ্ৰহণ করে পাটীগণিতে (Arithmetic) নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করে নেয়।
পোপ সিলভেস্টার (Pope Sylvester) ৯৭৬ সালে কর্ডোবা (Cordoba) থেকে ভারতীয় অঙ্ক(Indian Numerals) ইউরোপে নিয়ে গেলেও তার পদ্ধতি বুঝতে পারেন নি।
ফ্লোরেন্সের বণিকরা ভারতের অ্যালগরিদম(Algorithms) বুঝতে পারলেও খ্রীষ্টান জেসুইট দের পাঠক্রমে ব্যবহারিক গণিত ক্লভিয়াস(Clavius) এর মাধ্যমে ১৫৭২ সালের আগে অন্তর্ভুক্ত হয় নি।
এই ক্লভিয়াস ১৫৮২ সালে ক্রান্তীয় বছর( Tropical year) এর দিনসংখ্যা পরিবর্তন করে গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। প্রতি ১০০ বছরে লিপ ইয়ার কে বাতিল করে প্রতি ১০০০ বছরে লিপ ইয়ার করা হয়।তাই এখন ট্রপিক্যাল ইয়ার এর দিনসংখ্যা দাঁড়ালো ৩৬৫.২৫-০.০১+০.০০১=৩৬৫.২৪১।
ক্লভিয়াস কি করে এই সংশোধন করলেন?
এই সংশোধনের জন্যেও ভারতবর্ষ থেকে আমদানি করা জ্ঞানের ওপর তাকে নির্ভর করতে হয়েছিল।
কোনো প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ছাড়া করা গ্ৰেগরিয়ান সংশোধন কে প্রোটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বী ব্রিটেন (নিউটন সহ) তৎক্ষণাৎ গ্ৰহণ করে নি। নিউটনের মৃত্যুর পর ব্রিটেনে এই ক্যালেন্ডার গৃহীত হয়। অর্থাৎ , ইউরোপিয়ানরা সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বছরের নির্দিষ্ট দিনসংখ্যা জানতোই না।
১৫৮১ সালে ক্লভিয়াস এর ছাত্র ও জেসুইট গুপ্তচর রিসি (Matteo Ricci) ভারতের কোচি তে ভারতবর্ষের কালগণনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে ভারতে এসেছিল।রিসির একটি চিঠি থেকে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের তথ্যগুলি ইউরোপে পাচারের কথা জানা যায়।
ক্যালেন্ডারের এই সংশোধনের প্রয়োজনীতা সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।নৌযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যাভিগেশন এর জন্য একটি ভালো ক্যালেন্ডারের খুব প্রয়োজন।
ইউরোপের বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী হওয়ার স্বপ্ন সঠিক ন্যাভিগেশন এর পদ্ধতি ছাড়া এতদিন অধরাই ছিল। ন্যাভিগেশন এর প্রথম পদক্ষেপ হলো সমুদ্রে অক্ষাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি জানা।
১৭০৭ সালে এক সামুদ্রিক অভিযানে ব্রিটেনের ২০০০ জন নিখোঁজ হয়ে যায়।১৭১৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ন্যাভিগেশন এর সঠিক পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে।
ভাস্কো-দা-গামা(Vasco da Gama) ও কলম্বাস(Columbus) তা জানতো না।ভাস্কো কে একজন ভারতীয় নাবিক কনক(Kanaka) সমুদ্র পথ দেখিয়ে ভারতে এনেছিলেন এবং কলম্বাস ভারতের উদ্দ্যেশ্য যাত্রা শুরু করে আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিল।এই হচ্ছে সেই সময়কার ইউরোপের বিজ্ঞান এর উৎকর্ষতা!
সমুদ্রে সঠিক অক্ষাংশ নির্ণয়ের জন্যই পোপ গ্ৰেগরি ক্যালেন্ডার সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এখনো গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে মহাবিষুব একই দিনে আসে না।
গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে সম্পূর্ণভাবে একটি জাতির আবিষ্কার বলে মেনে নেওয়া যায় না কারণ গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার রোমান ক্যালেন্ডারের পরিবর্তিত ও সংশোধিত রূপ । আবার রোমানরা এই ক্যালেন্ডার গ্ৰীসের থেকে পেয়েছিল যা গ্ৰীসে পৌঁছেছিল মিশরীয়দের থেকে। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ থেকে মিশরে কালগণনা পদ্ধতি পৌঁছেছিল না মিশরে স্বাধীনভাবে এর বিকাশ হয়েছিল তার উত্তর এখনো অধরা।
রোমান ক্যালেন্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য ইউরোপকে ভারতের দিকেই তাকাতে হয়েছিল।আমরা জানি , বর্তমানে কোনো দেশ অন্য কোনো দেশকে উন্নত যন্ত্র রপ্তানি করলে সেই যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের প্রযুক্তি বিক্রেতা দেশটির কাছেই থাকে বা ঐ যন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের জন্য ক্রেতা দেশটিকে বিক্রেতা দেশের মুখাপেক্ষি হতে হয়।
ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল।আর ভারতবর্ষের কালগণনা পদ্ধতির ক্রমান্বয়ে বিকশিত হওয়ার এক নিজস্ব ইতিহাস আছে যা ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধীরে ধীরে উন্নত হওয়ার ইতিহাস।
ভারতবর্ষে কালপঞ্জি ঋকবেদ ও বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এর সময় থেকে অবিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।ঋকবেদ থেকে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এবং তার পরবর্তী কালে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট, বরাহমিহির,ভাস্করাচার্য্য পর্যন্ত ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং কালপঞ্জীর কয়েক হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের বিভিন্ন ঋকে সূর্যের উত্তরায়ণ, দক্ষিনায়ণ অবস্থান (১/২০/৬ ও ১/২০/৮) , ছয়টি ঋতুর (১/১৬৪/১৫ ও ১/৯৫/৩) কথা উল্লেখ আছে। ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ঋকগুলি কমপক্ষে ৯০০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দের আগে রচিত। কিন্তু ঋকগুলিতে বর্ণিত কাল গণনা পদ্ধতি ঋকগুলির রচনার আরো আগে শুরু হয়েছিল বলাই যায়।
ঋকবেদের চতুর্থ ,ষষ্ঠ ও নবম মন্ডলের বিভিন্ন ঋকে চাঁদের বিভিন্ন দশা ও স্থির নক্ষত্রের স্বাপেক্ষে সূর্য-চন্দ্রের অবস্থান নির্ণয় সম্পর্কে জানা যায়।
ঋকবেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্ৰন্থ।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় , ভারতবর্ষের কাল গণনা পদ্ধতি বিশ্বের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন।
নতুন ভাবে সংযোজিত বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এর সময়কাল প্রায় ৩৫০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দের। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্ৰন্থ বলে প্রসিদ্ধ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-এর আগে রচিত কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞান এর গ্ৰন্থের কথা বিশ্বের কোনো দেশে নেই।
ভারতবর্ষের পঞ্চাঙ্গ(Panchang) একটি Luni-Solar ক্যালেন্ডার যা বছরকে সূর্যের ঋতুচক্র অনুসারে ও মাসকে চাঁদের দশা অনুযায়ী হিসেব করে।
পঞ্চাঙ্গ অনুসারে , একমাসে ৩০ টি তিথি থাকে এবং সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে কৌণিক ব্যবধান ১২° হতে যে সময় লাগে তাকে এক তিথি বলে।
যদিও তিথি ও বর্তমানে দিনের সময়কাল এক নয়।সূর্যের ঋতুচক্র অনুযায়ী ১ বছর , চাঁদের দশা অনুযায়ী ১২ মাসের থেকে কিছুটা বেশি হয়।তাই আর কিছু অন্তর্বর্তী মাস(Intercalary month) বা অতিরিক্ত মাস এর প্রয়োজন যাকে আমরা ‘মলমাস’ বলে জানি।
আরবীয়রা , ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এর নীতি অনুসরণ করলেও তাদের কালপঞ্জি শুধুমাত্র চাঁদের দশার (Lunar Calendar) ওপর নির্ভরশীল। বৌদ্ধদের মাধ্যমে ভারতীয় কালপঞ্জী চীনে পৌঁছায়।
প্রাচীন ভারতের সম্পদশালী হওয়ার পেছনে দুটো কারণ ছিল , এক কৃষি ও অন্য বৈদেশিক বাণিজ্য।
এই দুই ক্ষেত্রেই সফলতার জন্য একটি ভালো কালপঞ্জীর প্রয়োজন ছিল। কৃষিক্ষেত্রে বর্ষাকাল নির্ণয়ের জন্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রযাত্রার উদ্দ্যেশ্য নেভিগেশনের জন্য। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধশালী অতীত প্রমাণ করে যে এইদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে ছিল। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া একটি ভালো কালপঞ্জী নির্মাণ করা সম্ভব হতো না আর ভালো কালপঞ্জি ছাড়া কৃষি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সফলতা অলীক কল্পনা ছিল। যদিও পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা এই সাধারণ বুদ্ধির প্রয়োগ কোনোদিন করেননি। তাইতো তাদের লেখায় বিশ্ব ভারতবর্ষের কাছে কতটা ঋণী তা প্রকাশ পায় না।
গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষা , অতিবৃষ্টি এবং খরার পূর্বাভাস প্রায়ই ভুল হতে দেখা যায়।
তাই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনও করছে কি না প্রশ্ন উঠতেই পারে।ভারতীয় কালপঞ্জি বর্ষার সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারবে কি না তা পরের প্রশ্ন কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছাড়াই এটিকে বাতিল করে দেওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
পরাণুকরণের এ এক লজ্জাজনক ও ক্ষতিকর দৃষ্টান্ত।
বেশিরভাগ মানুষ ভারতীয় কালপঞ্জি অনুযায়ী নিজেদের জন্মদিন বলতে পারবেন না। ভারতীয় উৎসবগুলির বেশিরভাগই যেমন দোলপূর্ণিমা ,বুদ্ধ পূর্ণিমা,মহাবীর জয়ন্তী , দিওয়ালী(অমাবস্যা) চাঁদের দশার উপর নির্ভরশীল যা আমরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার দেখে বলতে পারবো না। আমাদের ভারতীয় দীনপঞ্জীর উপর নির্ভরশীল হতেই হয় কারণ গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনগুলি স্থির নয়।
খুব দুঃখের বিষয় , আমাদের দুইটি উপাসনা-পদ্ধতি নিরপেক্ষ উৎসব , স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবস যা একটি খ্রীষ্টান আচারের জন্য প্রবর্তিত গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী স্থির হয়েছে।
গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার একটি অবৈজ্ঞানিক কালপঞ্জি। শুধুমাত্র এই কারণেই এটিকে বাতিল করা উচিত।
কোনো প্রামাণ্য তথ্য ছাড়াই ক্রুসেড-পরবর্তী কল্প-কাহিনীগুলিতে বিজ্ঞানে গ্রিক ও ইউরোপিয়ানদের উৎকর্ষতার যে দাবি করা হয় তা ভারতীয় কালপঞ্জি সমূলে উৎপাটিত করে এবং একইসাথে ভারতবর্ষের বৈজ্ঞানিক সক্ষমতার এক অকাট্য প্রমাণ আমাদের সামনে তুলে ধরে।
আমাদের যদি বেশ কিছুদিন একটি নির্জন দ্বীপে রেখে দেওয়া হয় তাহলে আমরা বর্তমানে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রচলিত সাল তারিখ ভুলে যাব আর একবার ভুলে গেলে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সঠিক দিন নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
কিন্তু ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের রীতি অনুযায়ী যে পঞ্চাঙ্গের (পাঁচটি অঙ্গ-তিথি , নক্ষত্র ,বার ,যোগ , কারণ) সাহায্যে কালনির্ণয় করা হয় সেই পদ্ধতিতে সূর্য , চন্দ্র ও নক্ষত্রের অবস্হান জেনে কাল নির্ণয় সহজেই করা যাবে।এই থেকেই প্রমাণিত সূর্য-চন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক গতি ও নক্ষত্রের অবস্হান কে কাজে লাগিয়ে নির্মিত কাল গণনা পদ্ধতি বর্তমানে প্রচলিত ক্যালেন্ডারের থেকে অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক।
শুধু তাই নয় , অতীতকালের কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সময় সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ও বিভিন্ন গ্ৰহের অবস্থান থেকে ঐ ঐতিহাসিক ঘটনা টি বর্তমান সময়ের থেকে কতদিন আগে ঘটেছিল তাও নির্ণয় করা সম্ভব।তাই ভারতীয় কাল গণনা পদ্ধতি ভারতীয় সংস্কৃতির মতোই সনাতন ।
বর্তমানে প্রচলিত গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার প্রমাণ করে যে , উৎকৃষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সারা বিশ্ব তখনই মান্যতা দেয় যখন সেই পদ্ধতির জন্মদাতা সংস্কৃতি সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নতুবা বিজয়ীর পদ্ধতিকেই বিজিত জাতি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষার বিরোধ’ প্রবন্ধের কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য
“গ্রীস একদিন পৃথিবীর রত্নভাণ্ডার লুটে নিয়ে গিয়েছিল, রোমও তাই করেছিল। আফগানেরাও বড় কম করেনি,—কিন্তু সেটা সত্যের জোরেও নয়, সত্য হয়েও থাকেনি। দুর্যোধন একদিন শকুনির বিদ্যার জোরে জয়ী হয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে দীর্ঘকাল ধরে বনে-জঙ্গলে উপবাস করতে বাধ্য করেছিল, সেদিন দুর্যোধনের পাত্র ছাপিয়ে গিয়েছিল, তার ভোগের অন্নে কোথাও একটি তিলও কম পড়েনি, কিন্তু তাকেই সত্য বলে মেনে নিলে যুধিষ্ঠিরকে ফিরে এসে সারা জীবন কেবল পাশাখেলা শিখেই কাটাতে হোতো। সুতরাং সংসারে জয় করা বা পরের কেড়ে নেওয়ার বিদ্যাটাকেই একমাত্র সত্য ভেবে লুব্ধ হয়ে ওঠাই মানুষের বড় সার্থকতা নয়।”
এখন , আমাদের সামনে প্রশ্ন আমরা ঔপনিবেশিকতার প্রতীক , খ্রিষ্টানদের আচার অনুযায়ী তৈরি করা , অবৈজ্ঞানিক গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার কে নিজেদের জীবনের অঙ্গ করবো , না ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতার প্রতীক উপাসনা-পদ্ধতি নিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানসম্মত ভারতবর্ষের নিজস্ব কালপঞ্জি কে অগ্ৰাধিকার দিয়ে বিশ্বের সামনে এক গর্বিত ভারতবাসী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো ?
অসাধারণ তথ্য।
সমৃদ্ধ হলাম
Thank you very much
ভারতবর্ষের নিজস্ব কালপঞ্জি কে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিশ্বের মধ্যে ভারত একমাত্র শ্রেষ্ঠ দেশ প্রাচীন ইতিহাস পড়ে তা আমরা উপলব্ধি করেছি। কিন্তু বর্তমান ইতিহাসে আমরা দেখছি যারা ভারতবর্ষকে আক্রমণ করল তারাই হয়ে গেল হিরো তাদের নাম ইতিহাসে বারবার বলা হয়।
Thank you very much