দাঁতের ব্যথার তীব্রতা নিয়ে প্রতিটি ভুক্তভোগীই ভীষণরকম ভীত থাকেন। কারও কথায়, এই ব্যথা নাকি মৃত্যুযন্ত্রণার সমান। কেউ বলে, আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়। অনেকের বক্তব্য, দাঁতে যেন সুচ ফোটানো হচ্ছে। দেখা গিয়েছে, অন্তিম পর্যায়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর ব্যথার থেকেও দাঁতের ব্যথার তীব্রতা অনেক সময়ই বেশি থাকে। তাই দাঁতের ব্যথা নিয়ে প্রতিটি মানুষকে প্রথম থেকেই সচেতন থাকতে হবে।
অবস্থান
দাঁতের উপরের আবরণকে বলে এনামেল। এর অন্দরে থাকে ডেন্টিন নামক একটি কাঠামো। এই ডেন্টিনের মধ্যে রয়েছে এক বিশেষ ধরনের স্নায়ু। সেখানে কোনও কারণে ইনফ্লামেশন (প্রদাহ) হলেই দাঁতে ব্যথা হয়। তবে এই ব্যথাকে শরীরের অন্য কোনও ব্যথার সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলাই ভালো। আসলে শরীরে অন্য কোথাও ইনফ্লামেশন হলে সেখানে তৈরি হওয়া রস বা রক্ত অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু দাঁতের স্নায়ু দাঁতের কঠিন অংশ দিয়ে ঘেরা থাকে। তাই সেখানে প্রদাহ থেকে রস তৈরি হলেও তা বেরিয়ে বা ছড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে দাঁতে ও দাঁতের স্নায়ুতে প্রবল পরিমাণ চাপের সৃষ্টি হয়। স্নায়ুর চাপ থেকেই অসহ্য ব্যথা শুরু হয়। চাপ যত বাড়ে, ব্যথাও সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে।
অনেকসময় নির্দিষ্ট দাঁতের ইনফ্লামেশনের যন্ত্রণা মুখের অন্য জায়গাতেও হতে পারে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বোঝা যাবে। ধরা যাক কোনও ব্যক্তির নীচের চোয়ালের বাম দিকের গোড়ার কোনও দাঁতে ইনফ্লামেশন হল। কিন্তু অনেকসময় সেই নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যথা না হয়ে, উপরের দাঁতে, কানের তলায়, কানের পিছনে ইত্যাদি নানা জায়গায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই ধরনের ব্যথাকে রেফার্ড পেইন বলে।
দাঁত ব্যথার কারণ ও চিকিৎসা
দাঁতে গর্ত: সঠিক উপায়ে দাঁত না মাজলে বা খাওয়ার পর ভালো করে মুখ পরিষ্কার না করলে দাঁতের মধ্যে খাবার আটকে থাকতে পারে। এবার সেই খাবার দাঁতের মধ্যে পচে গিয়ে অ্যাসিড তৈরি করে। এই অ্যাসিড দাঁতের ক্যালশিয়ামকে টেনে নেয়। ফলে দাঁতের সেই অংশে গর্ত তৈরি হয়। বারবার এই পদ্ধতিতে ওই নির্দিষ্ট অংশে দাঁতের ক্ষয় বাড়তে বাড়তে গর্তটি দাঁতের নার্ভ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেই তৈরি হয় সমস্যা। বাইরে থেকে গর্ত হয়ে রোগ-জীবাণু নার্ভে আক্রমণ করে। দেখা দেয় ইনফ্লামেশন। তখনই শুরু হয়ে যায় অসহ্য যন্ত্রণা। দাঁতের মধ্যে কালো দাগ হল গর্তের প্রাথমিক লক্ষণ। এছাড়াও নির্দিষ্ট জায়গায় বারবার খাবার আটকে যাওয়া, খাবার খেলে শিরশিরানি ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দেয়। এই সমস্যাকেই সাধারণের ভাষায় দাঁতে পোকা লেগেছে বলা হয়ে থাকে।
বেশি হয় যেখানে
সাধারণত মুখের একদম সামনে থেকে পিছনের দিক বরাবর ছয় নম্বর দাঁতটি এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ এই দাঁতের বাইরের আবরণ বেশ রুক্ষ। এখানেই খাবার বেশি আটকে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তাই এই নির্দিষ্ট দাঁতেই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। এছাড়াও যে কোনও দাঁত, বিশেষত সামনে থেকে চার, পাঁচ ও সাত নম্বর দাঁতেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। দাঁতে তৈরি হওয়া গর্ত দাঁতের নার্ভ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসা করানো ভালো। এটাই হল রোগের প্রাথমিক পর্যায়। এক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানে দাঁতে ফিলিং করতে হয়। অর্থাৎ দাঁতের গর্তকে নির্দিষ্ট উপায়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়। নানা ধরনের ফিলিং রয়েছে— টেম্পোরারি, সেমি পারমানেন্ট ও পারমানেন্ট। আবার দাঁতের গর্ত স্নায়ুতে পৌঁছে ইনফ্লামেশন তৈরি করলে চিকিৎসা বেশ কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দাঁত বাঁচানোর একমাত্র পথ হল রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট।
দাঁতে আঘাত লেগে ভাঙা
কোনও কারণে দাঁতে আঘাত লেগে নির্দিষ্ট অংশ ভেঙে গেলে বা ফ্র্যাকচার হলে নার্ভ এন্ডিং বেরিয়ে আসে। ফলে নার্ভে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। নার্ভে সংক্রমণ হলে তীব্র ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। এই সমস্যার সমাধানে দাঁতটিকে ক্যাপিং করতে হয়।
আবার অনেকসময় আঘাত লেগে পুরো দাঁতটি উপড়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানসম্মত ভাষায় এর নাম অ্যাভালশন। এক্ষেত্রে অন্তত এক ঘণ্টার মধ্যে সেই নির্দিষ্ট দাঁতটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা ওই দাঁতটিকে পুনরায় সেখানে বসিয়ে দিতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে আনার আগে দাঁতটিকে বিশেষ যত্ন করতে হয়। উপড়ে যাওয়া দাঁতটিকে সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রহ করে দুধ, ডাবের জল বা মুখের লালার মধ্যে ডুবিয়ে দিতে হবে। এরপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের কাছে আসা দরকার।
দাঁত খোয়া গেলে, বা কোনও কারণে দাঁতটি পুনরায় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠলে অবশ্য আর্টিফিশিয়াল ডেন্টাল ইমপ্ল্যান্ট করা দরকার। অর্থাৎ ওই জায়গায় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কৃত্রিম দাঁত প্রতিস্থাপন করতে হয়।
দাঁতের গোড়ায় নোংরা জমা
মাড়ি ও দাঁত একে অপরের সঙ্গে লেগে থাকে। এবার দাঁতের গোড়ায় ময়লা জমলে মাড়ি ও দাঁতের সম্পর্কে ছেদ পড়ে। একে অপরের থেকে দূরে সরে আসে। ফলে সেই জায়গায় অসংখ্য নার্ভ রুট বেরিয়ে যায়। এই নার্ভ রুটগুলির সংবেদনশীল হয়ে পড়লে মূল নার্ভে সেই বার্তা পৌঁছয়। এর থেকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মাড়ির চিকিৎসা করতে হয়।
হাড়ে ইনফেকশন
প্রাথমিকভাবে দাঁতের ব্যথাকে আমল না দিতে থাকলে তার থেকে দাঁতের নার্ভের মৃত্যু ঘটতে পারে। অনেকসময় তার থেকে মাড়ির হাড়ে ইনফেকশন হয়।
এক্ষেত্রে হাড়ে পুঁজ পর্যন্ত জমে। মুখ ফুলে যায়, জ্বর আসে, তীব্র যন্ত্রণা হয়। এর চিকিৎসা হল রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট। এছাড়াও বর্তমানে অত্যাধুনিক রিজেনারেটিভ থেরাপির মাধ্যমে এই সমস্যার চিকিৎসা সম্ভব। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ওই মৃত দাঁতটিকে জীবন্ত করে তোলা যায়।
রাতবিরেতে দাঁতে ব্যথা
অসময়ে দাঁত ব্যথা করলে যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে লবঙ্গ তেল লাগাতে পারেন। এছাড়া চাইলে প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও খাওয়া যেতে পারে। তবে ব্যথা কমাতে সেঁক দেবেন না। এর ফল হতে পারে উল্টো। মনে রাখবেন, এই সমস্যা একদমই ফেলে রাখা উচিত নয়। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।