Home Literature গল্পঃ ঘ্রাণ

গল্পঃ ঘ্রাণ

224
0

লেখক-……সুব্রত চৌধুরী


(১)
ছেলেটা অনেক্ক্ষণ ধরে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কার্তিকের মাঝামাঝি সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবো হবো করছে, শীত শীত আমেজ এসে যাওয়ায় অগ্রহায়ণ মাস সামনে রেখে অনেকেই উঠানের এক কোনায় নতুন বানানো মাটির চুলায় রান্নার সূচনা করে। আটপৌরে শাড়িপরা মাঝবয়সী যে মহিলাটি উঠানে রান্না করছে তার ঠিক হাত সাতেক পিছনেই ছেলেটা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
” মাগো আমায় দুটো ভাত দিবেন, খুব খিদে লেগেছে। “
আচমকা এমন কথায় মহিলাটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল। এমন মা ডাক সে কখনোই শোনেনি! তার দুটো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে কোন পুত্র সন্তান নেই।ছেলেটির বয়স বছর আঠারোর মত হবে, শ্যামলা গড়ন, চোখ দুটো বেশ বড় বড়। প্রথমে মনে হয়েছিল ভিখারি কিন্তু দেখে তেমনটা মনে হচ্ছে না, চোর ছ্যাচড়া না তো! মহিলা এবার খানিকটা ভয় পেয়ে গেল।
” কে গো বাছা তুমি, তুমার বাড়ি কোন জাগা? এরাম করে বাড়ির মদ্দি ঢুকে আইসলে যে! শোন, রান্না টান্না শেষ হয়নি একনো। তুমি বাপু যাও। “
” মাগো আমি দুদিন ধরে কিছুই খায়নি। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় খিদে পেটে আপনার তরকারি রান্নার ঘ্রাণ নাকে এলো। পুঁটি মাছ দিয়ে মুলা, বেগুন, আলু আর পালংশাকের ঝোল আমার খুব পছন্দ তাই লোভ সামলাতে না পেরে ঢুকে পড়লাম “। ছেলেটার এই কথায় বেশ চমকে গেল মহিলা। সে আসলেই এই তরকারি রান্না করছে ছেলেটা জানলো কিভাবে!
” মাগো আমি মিষ্টি কুমড়ো ভাজির গন্ধটাও পাচ্ছি ওটাও আমার পছন্দ। “
মহিলা এবার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এ ছেলে এতসব জানলো কিভাবে! এ তো যেমন তেমন ছেলে নয়,সাধু টাধু নাকি? তার স্বামী ঘরের মধ্যে ঘুমাচ্ছে অগত্যা তাকেই ডাকলো মহিলা।
মহিলার স্বামী দুপুরের ঘুম ঘুমাচ্ছিলো। ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে লুংগীর গিট ঠিক করতে করতে উঠানে নেমে এলো।
” কিরে কী ব্যাপার কাচা ঘুমডা ভাঙালি যে, এই ছ্যামড়া কিডা, কী চাচ্চে?”
” শোন, এই ছেলেডা কয়ডা ভাত চাচ্চে খাওয়ার জন্যি আর গন্ধ শুকেই বইলে দেচ্চে কী দিয়ে কী রান্না করিচি। তুমি কি ছেলেডারে চেন? আমার কিরাম সন্দেহ হচ্চে। ” এক নিঃশ্বাসে বলে চললো মহিলা।
” এই তুমার নাম কী, বাড়ি কোন জাগা, এই গ্রামে কী জন্যি আইচো?” মহিলার স্বামী নিরঞ্জন অচেনা ছেলেটার হাত চেপে ধরলো চোর বা আসামী ধরার ভঙ্গিতে ।
” কাকা, বিশ্বাস করেন আমি চোর না। আমি দুইদিন সত্যিই কিছু খায়নি আর আমার নাম, বাড়ি কোন কিছুই আমার মনে পড়ছে না। আমি এখানে কিভাবে এলাম তাও বুঝতে পারছিনা। “
” তুমি পাগল না এইডা বুজিছি কিন্তু তুমার রহস্য তো বুচতিছিনা, গন্দ শুকে বলে দেচ্চ বিষয়ডা কী! আচ্চা আমার মুখ শুকে কওতো কিসের গন্দ পাচ্চো?” স্বামী স্ত্রী দুজনেই রহস্যভরা চোখে ছেলেটার দিকে তাকালো।
” আপনার মুখ দিয়ে জিলাপি’র গন্ধ আসছে, বোধহয় দুপুরের দিকে খেয়েছেন।”
ছেলেটির এই কথায় চমকে উঠলো নিরঞ্জন আর তার স্ত্রী, সত্যিই তারা দুপুরে জিলাপি আর মুড়ি খেয়েছে। এ তো আসলেই সাধারণ কেউ নয়, গন্ধ শুকে বলে দিল জিলাপি! নিরঞ্জন মহালদার ছেলেটির হাত ছেড়ে দিল। তারপর বেশ বিনয় নিয়ে বললো ” তুমার কি আসলেই কিছু মনে পড়চে না বাবা? “
ছেলেটা ঘাড় নেড়ে না সূচক উত্তর দিল।
“ঠিক আচে তুমি চিন্তা কইরোনা, আমার এই গরীব ঘরে দুডো খাওয়া দাওয়া করো তারপর তুমারে নিয়ে আমি চেয়ারম্যান সাহেবের কাচে যাবো। তুমি সাধারণ কেউ নাগো সাধারণ কেউনা!”
(২)
চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে আজ বেশ আয়োজন অনেক পদের রান্না হচ্ছে। রাতে এসিল্যান্ড সাহেবের দাওয়াত সাথে আরো কয়েকজন আসবে। চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী আর মেয়ে রান্না নিয়ে মহা ব্যস্ত আর ছেলেটার দই আর মিষ্টি নিয়ে অনেক আগেই আসার কথা কিন্তু সে এখনো ফেরেনি সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
চেয়ারম্যান সাহেবের মেজাজ খারাপ হলো ‘এই ছেলেই তার মান সম্মান সব ডুবাবে। ডুবাবে কি হারামজাদা ডুবিয়ে বসে আছে, এ বার আই.এ পরীক্ষায় ফেল করেছে!’ ইদানিং নানা চিন্তায় তার রাতে ঘুম আসেনা, প্রায়ই স্বপ্নে স্ত্রী আর মেয়েটার মৃত্যু দৃশ্য দেখে। আল্লাহই জানে কপালে কী আছে। বারান্দায় পেতে রাখা অনেকগুলো চেয়ারের একটাতে বসে আরেকটির উপর পা তুলে দিলেন তি”চেয়ারম্যান ভাই আদাপ, ভালো আচেন? “
নিরঞ্জন মহালদারের কথায় চিন্তার ছেদ পড়লো চেয়ারম্যান সাহেবের।
“এসো নিরঞ্জন, সাথে কে? শোন বেশি কথা বলতে পারবো না অনেক ঝামেলছি। “
“ভোট দিয়ে যকন চেয়ারম্যান বানাইচি কতা তো শুনাই লাগবে। আরে ভয় নেই কিচু চাতি আসিনি দিতি আইচি আপনের কাজে লাগতি পারে।”
” হুম তোমার হেয়ালি স্বভাব আর গেলনা। চেয়ারে বসে বলো কী বলতে চাইছো
” সাতে যে অচেনা ছেলেডারে দেকচেন এ সধারণ কেউ না এর অনেক গুণ, এ গন্ধ শুকেই সব কিচু বলে দিতি পারে।” নিরঞ্জন মহালদার আজকে তার বাড়ির ঘটনাটা চেয়ারম্যান সাহেবেকে শোনালো। সব শুনে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন ” তা আমার বাড়িতে কী কী রান্না হয়েছে বা হচ্ছে? “
ছেলেটা কিছুক্ষণ সময় নিলো তারপর ঠাঁই দাঁড়িয়ে গড়গড়িয়ে বলতে লাগলো ” পারশে মাছ ভাজি, নারিকেলের দুধ দিয়ে বাগদা চিংড়ি, ভেটকি মাছ ভুনা রান্না হয়েছে । ” চেয়ারম্যান সাহেব বিস্মিত হলেন ছেলেটার এরুপ মন্তব্যে ।
“তাজ্জব ব্যাপার তোমার কথা মিলে গেছে, আসলেই এগুলো রান্না হয়েছে। তবে তুমি কিন্তু আরেকটি রান্নার কথা বলোনি যেটা এখন রান্না হচ্ছে। কী মাংস রান্না হচ্ছে সেটা বলতে পারলেই বুঝবো আসলেই তুমি অন্য ধাচের গুণী মানুষ।”
চেয়ারম্যান সাহেব ভাবলেন মাংসের কথাটা এ ছেলে বলতেই পারবেনা কারণ এখন রান্না হচ্ছে ভেড়ার কচি মাংস।
” স্যার মাংসের কথা বললে আপনারা ঠিক বিশ্বাস করবেননা, আপনারা আমার উপর রেগেও যেতে পারেন।” বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেটা মাথা নীচু করে নরম সুরে বললো।
” আহা তুমি ভনিতা না করে সরাসরি বলোতো, তোমার গন্ধ শুকে বলাটা আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। ” চেয়ারম্যান সাহেব ধরে নিলো এ ছেলে এবার আর পারবেনা, আরে বাবা মাছ আর মাংস এক জিনিস নয়, অত সোজা না গন্ধ শুকে সবকিছু বলা! ভাওতাবাজি আর কতক্ষণ।
” যে মাংসটা রান্না হচ্ছে সেটা কুকুরের মাংস! “
ছেলেটা মুখ নিচু করেই বললো।
চেয়ারম্যান সাহেবের বউ আর মেয়ে রান্নাঘর থেকে এতক্ষণ এই আলোচনা শুনে বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলো। এখন কুকুরের মাংসের কথা শুনেই তার বউ “আল্লাহ গোওও ” বলে চিতকার দিয়ে কড়াইয়ের মাংস টা উপুড় করে ঢেলে ফেললো আর মেয়েটা চুলার পাশেই হড়হড় করে বমি শুরু করলো। চেয়ারম্যান সাহেবের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও তার শরীরে যুবকের মত শক্তি, ছেলেটার গালে প্রচন্ড এক থাপ্পড় মেরে বারান্দা থেকে উঠানে ফেলে দিল। এত সাধের ভেড়ার মাংসকে এই শুয়োরের বাচ্চা বলে কিনা কুকুরের মাংস! বড় গন্ধ বিশারদ হয়েছে, হারামজাদার নাকে গু ঘষে দেওয়ার দরকার।
নিরঞ্জন মহালদার ছেলেটাকে উঠোন থেকে টেনে তুললো, ঠোঁটের কোনা থেকে রক্ত ঝরছে।
“স্যার আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তবে কসাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন, আমি মিথ্যা বলিনা স্যার “। ছেলেটার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ঠিক এইসময় চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে দই মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলো। ” আব্বা, সর্বনাশ হয়ে গেছে, আজ হাটে জব্বার কসাইকে পুলিশ এরেস্ট করেছে ভেড়ার পরিবর্তে কুকুরের মাংস বিক্রির অপরাধে। আর তোমার এসিল্যান্ড সাহেব এই অভিযানে ওখানে ছিল উনি বোধহয় আর তোমার ভেড়া খাওয়ার দাওয়াতে আসবেন না। “
ছেলেটাকে চড় মারার ঘটনায় চেয়ারম্যান সাহেব মনে মনে লজ্জিত হলো আর ছেলেটার প্রতি তার বেশ মায়া হলো, খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে ” নিরঞ্জন শোন, ছেলেটাকে আমার বাড়িতে রেখে যাও, ওকে নিয়ে আমার অনেক প্লান আছে। আর শোন ছেলেটার এই গুণের কথা ইউনিয়নের কেউ যেন জানতে না পারে, মাছ ভাত খেতে চাইলে রাতে খেয়ে যেও।”
(৩)
মাসখানেক হয়ে গেল ছেলেটা এ বাড়িতে আছে। চেয়ারম্যান সাহেব আর তার স্ত্রী ছেলেটাকে খোকা বলে ডাকে। আজ বাড়িতে চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে রুমানা আর খোকা ছাড়া কেউ নেই। রুমানা ক্লাস টেনে পড়ে মানবিক বিভাগে।সে তার মায়ের মতই সুন্দরী, বাড়ির বাইরে বের হলে বোরকা পরে বের হয়। রুমানা তার ঘরে খাটে বসে পা ঝুলিয়ে দোলাচ্ছে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খোকা। কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর চোখের কাজল মিলে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ঘরের দেয়াল জুড়ে নায়ক সালমান শাহর ছবি টাঙানো। মাস কয়েক আগে যখন সালমান মারা যায় অন্য অনেকের মত রুমানাও কেঁদে বুক ভাসিয়ে ছিলো।
” খোকা ভাই, আপনি কেমন আছেন? “
“ভালো আছি”।
” আব্বা আম্মা যে আমাকে আর আপনাকে বাড়িতে রেখে ভাইয়াকে সাথে নিয়ে দাওয়াত খেতে গেল এর মানে বোঝেন “
” না বুঝি না “
” গন্ধ শুকে এত কিছু বোঝেন আর এটা বোঝেননা। ঠিক আছে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আব্বার ধারণা আপনি পীর দরবেশ টাইপের মানুষ। আব্বা ভবিষ্যতে এমপি, মন্ত্রী হতে চায় তাই আপনাকে জামাই বানিয়ে রেখে দিতে চায়। এবার বুঝলেন? “
” বুঝলাম। “
” কিছুই বোঝেননি, আপনি অতো দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন আমাকে ভয় লাগে আপনার “
” না। “
” তাহলে আমার পাশে বসেন।”
খোকা রুমানার পাশে এসে খানিকটা গ্যাপ রেখে বসলো।
” এবার বলেন তো আপনি আসলে কে, আর আপনার মতলবটা কী?”
” আমার কোন মতলব নেই।”
” এবার বলেন আমার শরীর থেকে কিসের গন্ধ পাচ্ছেন আপনি? আহা দূরে কেন আরো কাছে আসেন। এবার বলেন কিসের গন্ধ?”
” লাক্স সাবানের গন্ধ। “
উত্তর শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো রুমানা তার বুক থেকে ইতিমধ্যে উড়না নীচে পড়ে গেছে। সে এখন খোকার গা ঘেঁষে বসে আছে। খোকা মুখ নিচু করে প্রতিটি কথার উত্তর দিচ্ছে। “খোকাবাবু শুধু বাইরের গন্ধ শুকলেই হবে হৃদয়ের গন্ধ শুকবে কে…বলো কে!” রুমানা ফিসফিসিয়ে কথাগুলো খোকার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, তার সারা শরীরে এখন প্রচণ্ড উত্তাপ জ্বরের ন্যায়। “বলো খোকা সোনা আর কিসের গন্ধ পাচ্ছো?”
” বললে আপনি রাগ করবেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন। ‘
“আমি কিচ্ছু মনে করবোনা, তুমি বলো প্লিজ বলো। ” উত্তেজনায় কাপছে রুমানা।
“আপনি এই মুহুর্তে ঋতুমতী। আপনার শরীর থেকে ওরকম গন্ধই বেরিয়ে আসছে”।
খোকার এই কথায় অত্যাশ্চর্য হয়ে গেল রুমানা সে আসলেই ঋতুমতী তার পিরিয়ড চলছে! মানুষটা আসলেই রহস্যময়, সব কিছুর গন্ধই সে নির্ভুল ভাবে বলতে পারে। শুধু আব্বা নয় তার নিজেরও এই মানুষটাকে দরকার, ভীষণ দরকার । রুমানা তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে খোকাকে জড়িয়ে ধরলো।
(৪)
চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের নাম রুপম। রুপম শুধু আইএ পরীক্ষায় ফেল করেছে তাই নয় তার ইদানীং বাজে সঙ্গী সাথী জুটেছে। রুমানা জানতে পেরেছে তার ভাই ফেনসিডিলে আসক্ত। খোকা যে এই বাড়িতে আছে এটা রুপমের খুবই অপছন্দ, সে তার বোনকে বলে দিয়েছে রহস্যময় ছেলেটার সাথে সে যেন কথা না বলে।
রুমানা তার ভাইকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তার আর খোকার ব্যাপারে নাক গলালে সে আব্বাকে ফেনসিডিলের বিষয়টি বলে দেব। এর ফল ভালো হবেনা বলে রুপম তার বোনকে শাসিয়েছে।
খোকা তার রুমে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালো, ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাস এটা। সে কেন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে তা এতোদিনেও মনে করতে পারেনি। তার নিজের মা বাবা ঘর বাড়ি কোন কিছুই তার মনে পড়ছে না। রুমানা মেয়েটা তাকে কেন এত পছন্দ করে তাও সে বুঝে উঠতে পারছে না। রুপম কিছুদিন আগে তাকে মেরে ফেলার হুমকি কেন দিলো তাও তার মাথায় ঢুকছেনা। খোকা সিদ্ধান্ত নিলো এ বাড়িতে সে আর থাকবে না।
রুমানা আর তার আম্মা হন্তদন্ত হয়ে খোকার রুমে প্রবেশ করলো ” বাবাজি তুমি কি জানো আমার ছেলে রুপম কোথায় গেছে? “
” না, জানিনা”।
” সে গতকাল বিকেলে বাড়ি থেকে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য বেরিয়েছে আজ বিকেল অব্দি তার কোন খোঁজ পাচ্ছিনা বাবা। আমি ভেবেছিলাম কোন বন্ধুর বাড়িতে রাত্রে থেকে গেছে তাই অতটা চিন্তা করিনি। আজ সকালে ওর দুই বন্ধু এসে জানাল কাল খেলায় হেরে যেয়ে নাকি ওদের এক বন্ধুকে প্রচণ্ড মারপিট করে তার গলার চেইন ছিড়ে নিয়ে এসেছে, ওরা এসেছিল সেই চেইন ফেরত চাইতে। আমি আর রুমানা ওর চেনাজানা সব জায়গায় খোঁজ করেও পায়নি, আমার বড্ড ভয় করছে বাবা।” একটানা কথা শেষ করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রুমানা’র আম্মা।
” খোকা ভাই তুমি তো জানো আব্বা ঢাকা গেছে মিটিংয়ের জন্য। আমি আর আম্মা সারাদিন ভাইয়ার তালাশ করেও কোন কুল কিনারা পেলাম না। তুমি কিছু করো খোকা ভাই।” এবার রুমানাও কান্নায় ভেঙে পড়লো।
” কিন্তু আমি তো রুপম ভাইয়ের শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছি, তবে ঘ্রাণটা কেমন উৎকট, পঁচা। “
এই কথায় আৎকে উঠলো রুমানা আর তার আম্মা।
“ঐ যে বিলের ওপাশ থেকে গন্ধটা ভেসে আসছে। ” জানালার ভিতর আঙুল দিয়ে বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে উত্তর দিকের বিলের দিকে ইঙ্গিত করলো খোকা।
ঘোর সন্ধ্যা, চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির উঠানে লোকে লোকারণ্য। বিল থেকে রুপমের লাশ তুলে আনা হয়েছে, মৃতের শরীর ফুলে ঢোলের আকার নিয়েছে, শরীর থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছে। ঢাকায় চেয়ারম্যান সাহেবকে টেলিফোন করা হয়েছে। রুপমের আম্মা খানিক পরপরই মূর্ছা যাচ্ছে। রুমানা কান্নাকাটির এক পর্যায়ে ভিড় গলিয়ে খোকার রুমে এসেছে। খোকা এখনো সেই জানালার পাশে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। রুমানা খোকার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলতে লাগলো ” খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তোমাকে বলবো খোকা ভাই তুমি প্লিজ মন দিয়ে শোন। আমার ভাইয়া কেন খুন হয়েছে আমি খানিকটা বুঝতে পারছি। তবে অনেকেই তোমায় সন্দেহ করবে কিন্তু আমি জানি এর সাথে তোমার বিন্দু মাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। তোমার মত ভালো মানুষ পৃথিবীতে নাই খোকা ভাই। একটু পরেই পুলিশ আসবে অনেক ঝামেলায় পড়বে তুমি, তোমাকে এক্ষুনি পালাতে হবে।”
“তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো।”
“পারছি।”
“তবে প্লিজ পিছনের দরজাটা দিয়ে চলে যাও, আমি জানিনা কোথায় তোমার বাড়ি আর তুমি যাবেই বা কোথায় তবু তোমাকে পালাতে হবে। আর শোন আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি তুমি হয়তো কোন দিনই তা বুঝতে পারবেনা। যদি কোনদিন তোমার সব স্মৃতি আবার ফিরে আসে সেদিন মনে করো ” রুমানা ” নামের একজন মানুষ তোমার শরীরের তাজা ঘ্রাণের অপেক্ষায় আছে আর প্রয়োজনে থাকবে আরো একশত বছর। ” রুমানা কান্না ভেজা কন্ঠে কথাগুলো শেষ করে খোকার হাতের উপর হালকা একটা চুম্বন এঁকে আবার উঠানের দিকে পা বাড়ালো।

খোকা দৌড়াচ্ছে, অন্ধকারের বুক চিরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে দৌড়াচ্ছে। এবার খুব পরিচিত একটা ঘ্রাণ তার নাকে আসছে, তার মায়ের শরীরের সুঘ্রাণ। অকস্মাৎ খোকার মাথার ভিতর বিদ্যুৎ গতিতে কী যেন ঢুকে পড়ে আর তারপরই তার সব মনে পড়ে যায় ! এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে তার স্ট্যান্ড করার কথা ছিল কিন্তু সামান্য কিছু মার্কের জন্য সে ব্যর্থ হয়। রাশভারি শিক্ষক বাবার আরাধ্য স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় পুত্রকে নানা কটুকথা বলে গালে একটা চড় মারে আর তারপর পুত্র রাগে, ক্ষোভে, যন্ত্রণা আর অভিমানে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে বাড়ি ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে চলতে থাকে।
খোকার আসল নাম মনে পড়ে যায় সে আরো জোরে দৌড়াতে থাকে মায়ের সুঘ্রাণের অপেক্ষায়। কিন্তু তার পিছন থেকে মানুষ রূপী কিছু হায়েনার কটু গন্ধ ক্রমশ তীব্র হতে থাকে।
। সমাপ্ত।

Previous articleঅভিনেত্রী লাভলি মৈত্র বিধানসভার প্রার্থী, বদলি হলেন আইপিএস স্বামী
Next articleদিলীপ ঘোষ মমতাকে কেন বারমুডা পরতে বললেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here