কিডনির অসুখ ও ব্যাপকতা: সারা বিশ্বে প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ বিভিন্ন কারণে কিডনির অসুখে আক্রান্ত। প্রতিবছর ২৪ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে শুধুমাত্র ক্রনিক কিডনির অসুখে!
অন্যদিকে আকস্মিক কিডনির অসুখ অর্থাৎ অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরিতে ভোগেন বিশ্বের প্রায় ১৩ কোটি মানুষ এবং তাঁদের বেশিরভাগই মধ্য বা নিম্নমধ্যবিত্ত দেশগুলিতে হয়। বহুলাংশে এরাই ক্রনিক কিডনি রোগের শিকার এবং প্রায় সতেরো লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় এই অসুখে।
শুধু তাই নয়, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বিভিন্ন কার্ডিও ভাসকুলার অসুখে এবং নানা সংক্রমণে (ম্যালেরিয়া টিউবার ক্যুলোসিস, হেপাটাইটিস, এইচআইভি) কিডনির এই অসুখ যেমন বেড়ে যায় তেমনি এই সমস্ত অসুখে কিডনি আক্রান্ত হলে রোগের জটিলতা বাড়ে এবং মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পায়। শিশুরাও কিডনির অসুখের করাল গ্রাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। কিডনির অসুখে বাচ্চার শৈশব যেমন নষ্ট হয়— ভবিষ্যৎও সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর্থিক দিক থেকেও দেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় এক বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।
কিডনি অসুখ—বৈষম্য ও অপ্রতুলতা: ক্রমবর্ধমান কিডনির এই সমস্যা থাকলেও সকলের জন্য অথবা সর্বত্র কিডনি চিকিৎসার পরিষেবা খুবই অপ্রতুল। দারিদ্র্য, লিঙ্গবৈষম্য, অশিক্ষা, পরিবেশ দূষণ প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়লেও কিডনি স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীন বহু দেশ। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ব্যাপক বৈষম্য।
কিডনি প্রতিস্থাপন এই রোগের সমাধান হলেও সেক্ষেত্রেও রয়েছে সমূহ সমস্যা। ডোনারের অভাব, উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন চিকিৎসার ব্যবস্থা, ধর্মীয় এবং আইনগত সমস্যা, সর্বোপরি চিকিৎসার খরচ এখানে বিরাট বাধা। ফলে অনেককেই জীবনভর ব্যয়বহুল ডায়ালিসিসের মধ্যেই কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতেও বহু দেশে সুস্পষ্ট কিডনি চিকিৎসা বা পরিষেবার কোনও রূপরেখা বা গাইডলাইন নেই। কিডনি রোগের নির্ণয় চিকিৎসা বা রোগ প্রতিরোধের বিষয়েও উদাসীন বহু দেশ। স্বাস্থ্য বাজেটের খুবই কম বরাদ্দ হয় এই ভয়ঙ্কর মারণ ব্যাধির নিরাময়ে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা।
কিছু পরিসংখ্যান সারাবিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে এই কিডনির অসুখের সম্বন্ধে।
সমগ্র পৃথিবীর লোকসংখ্যার দশ শতাংশ ক্রনিক কিডনির অসুখের শিকার। দশ লক্ষের অধিক এই রোগীর প্রতি বছর প্রাণ হারান শুধুমাত্র চিকিৎসার অভাবে। কুড়ি লক্ষের সামান্য বেশি ভাগ্যবান রোগী যাঁরা কিডনি প্রতিস্থাপন বা ডায়ালিসিস চিকিৎসার মধ্যে আছেন তাঁরা বস্তুত সমস্ত রোগীর দশ শতাংশ মাত্র। তাঁদের বেশির ভাগই ধনীদেশের। সেই দেশগুলির জনসংখ্যা সারা বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ। অন্যদিকে একশো উন্নয়নশীল দেশ যারা সমগ্র পৃথিবীর পঞ্চাশ শতাংশ জনগণের ধারক শুধুমাত্র কুড়ি শতাংশের চিকিৎসার সুযোগ মেলে। ফলে চীন, ভারতের মতো দেশে যেখানে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বেশি এই কিডনির অসুখ বাড়বে দ্রুত এবং ডায়ালিসিস, কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য সরকারকে পড়তে হবে আর্থিক সঙ্কটে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মার্কিন মুলুকে প্রতিবছরে শুধুমাত্র ক্রনিক কিডনির অসুখে খরচ হবে ৪৮ বিলিয়ন ডলার, চীনের মতো দেশে আগামী দশ বছরে হার্ট ও কিডনির অসুখের জন্য গুনতে হবে ৫৫৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
কিডনি সচেতনতার মূল বার্তা: মূল বার্তা হল ‘কিডনির স্বাস্থ্য সকলের জন্য এবং সর্বত্র।’
ক্রমবর্ধমান এই রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে এবং দ্রুত রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা সর্বোপরি রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতেই এই প্রয়াস। কিডনি রোগের সামগ্রিক চিকিৎসা এবং স্থায়ী গ্রহণযোগ্য জনমুখী কিডনি স্বাস্থ্যনীতি রূপায়ণই এর মূল লক্ষ্য।
মূল ভাবনাগুলি হল—
১) স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন—
বিশুদ্ধ, পরিশ্রুত জলের ব্যবহার, নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা, পুষ্টিকর খাদ্য, ধূমপান বর্জন। এতে কিডনির বহু অসুখ প্রতিরোধ বা প্রতিহত করা সম্ভব।
২) প্রাথমিক স্তরে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা—
কিছু রক্ত ও মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে হাই রিস্ক জনগণকে চিহ্নিত করা তাদের যথোপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাতে রোগ জটিল না হয় এবং এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিজে এ না পৌঁছয়।
৩) কিডনি রোগীদের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করা।
ব্লাডপ্রেশার, কোলেস্টেরল যাতে ঠিক থাকে বা প্রয়োজনীয় ওষুধ সুনিশ্চিত করা যাতে রোগ না বাড়তে পারে।
৪) স্বচ্ছ, স্থায়ী এবং সকলের গ্রহণযোগ্য উপযোগী স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণ করা— যাতে সকলেই উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন আধুনিক চিকিৎসার (কিডনি প্রতিস্থাপন, ডায়ালিসিস) সুবিধা গ্রহণ করতে পারে।
৫) আর্থিক সুরক্ষা—
আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে, আর্থসামাজিক বিভেদকে দূরে সরিয়ে, চিকিৎসা পরিষেবা বিস্তৃত করা এবং সকলের জন্য উন্নত কিডনি স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করা।
এবারের বিশ্ব কিডনি দিবসের স্লোগান—
‘বিশ্ব কিডনি দিবস
কিডনির স্বাস্থ্য সকলের জন্য এবং সর্বত্র’।
তাই এই বিশ্ব কিডনি দিবসে যে প্রয়োজনীয় তথ্য সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া জরুরি সেগুলো হল— কিডনি সুস্থ রাখতে
১। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে নিয়মিত সঠিক ওষুধ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত প্রেশার দেখতে হবে।
২। রক্তে শর্করার পরিমাণ সঠিক রাখতে হবে। ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগীদের ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রায় ওষুধ খাওয়ার সঙ্গে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে।
৩। খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। অধিক লবণ, দেশীয় ভেষজ, আয়ুর্বেদিক ওষুধ ব্যথা কমানোর ওষুধ, কোল্ড ড্রিংকস, টক জাতীয় ফলের রস ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। পরিমিত জল, স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হবে। এছাড়া ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, বা স্টোরেজ ফুড এড়িয়ে চলতে হবে।
৪। ধূমপান বর্জন করতে হবে এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।
৫। কিডনি রোগের কোনও উপসর্গ যেমন শরীর ফুলে যাওয়া, প্রস্রাব কমে বা বেড়ে যাওয়া, ইত্যাদি দেখা দিলে রক্ত ও ইউরিন টেস্ট করিয়ে দ্রুত রোগের চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সকলকে অবগত করতে হবে যাতে রোগ বেশি মারাত্মক হওয়ার আগেই রোগী চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে।