মৃন্ময় ভট্টাচার্য
সুকুমার রায় যে ষষ্ঠীচরণকে চিনতেন, তিনি গত হয়েছেন কবে তা আমার জানা নেই। তবে আমার শৈশব কৈশোরের বন্ধু, সব বিষয়ে না হলেও, খাদ্য রসিক হিসাবে অবশ্যই ষষ্ঠীচরনের উত্তরপুরুষ। হাতি সে লোফে না, কারণ এযুগে হাতি হাতের কাছে সহজে মেলে না। তবে "মুখেন মারিতং জগৎ" ষষ্ঠীকে আমি প্রায়শই 'বাঘের মাসি'-কে দুহাতে লোফালুফি করতে দেখেছি।
ষষ্টীর ভুড়িভোজনের অনেক মজার মজার গল্প আছে, মাত্র দু-তিনটে বলে তার ষষ্ঠীত্বের প্রমাণ দেবো।
একবার শুনলাম ও যখন ডিনার করছিল, মাঝপথে ওর বাবা সদর দরজার মোটা হুড়কো নিয়ে ওকে তাড়া করেছিলেন, বেচারা আধপেটা খেয়ে খাবারের থালা ফেলে, দিয়েছিল দে দৌড়। ওর বাবার এই নৃশংসতার কথা শুনে তাঁর প্রতি মনে মনে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। পরদিন ষষ্ঠীর কাছে ঘটনাটা জানতে চাইলে ও বললো, "দুই দিদির সাথে ও বাজি ধরে খেতে বসেছিল, সবে ছাপ্পান্নটা লুচি ও এক ডেকচি তরকারি উদরস্থ করেছে কি,ভাইয়ের নালিশ পেয়ে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে হুড়কো হাতে বাবার প্রবেশ...... ব্যাস বিশ্ব রেকর্ড করার হাতছানিটা হাতছাড়া হয়ে গেল।"
ষষ্ঠীর চেহারাটা ষষ্ঠীচরণের মতো পেশীবহুল, শক্তপোক্ত নয় মোটেই, একেবারে ছাপোসা, নিত্য আমাশায় ভোগা, এলেবেলে বাঙালির মতো, তবে দেহের ভীতরটা নিশ্চিত ভাবেই ইউনিক। আমার ধারণা ওর পাকস্থলীটা কপাল থেকে পাক খেতে খেতে হাটুর উপর পর্যন্ত বিস্তৃত। তা না হলে এতো হাঁড়ি হাঁড়ি খাবার ঢোকে কোথায়!
যখন আমাদের সঙ্গে ষষ্টী কোনো নিমন্ত্রণ বাড়িতে যায়, আমরা নিজেদের খাওয়ার বদলে ওর খাওয়া দেখতেই বেশী উৎসাহ বোধ করি। মজা পাই গৃহকর্তার কঠোর ক্ষুদ্ধ মুখে নতুন অতিথিদের আপ্যায়নের করুণ হাসি মাখা মুখটা দেখে। বন্ধুমহলে যারা ওর পাকস্থলির ক্ষেত্রফল জানে, তারা তাদের বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানের একমাস আগে থেকেই ওকে এড়িয়ে চলে। ষষ্ঠীর পেট ও নিমন্ত্রণকারির করুণ মুখমন্ডল, প্রায়শই আমাদের আড্ডার মূল উপাদন, ষষ্টী বাদে বাকি সবাই প্রাণখুলে হাসি, কারো কারো হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যায়, চোখে জল এসে যায়। বাড়িতে রাত্রে খাবার টেবিলে যখন মা, দিদি আর আমি ষষ্ঠীর কথা আলোচনা করি, ভীষণ রাশভারি আমার বাবা খুব গম্ভীর মুখে সব কথা শোনেন, কোনো মন্তব্য করেন না।
বাংলায় একটা প্রবাদ বেশ প্রচলিত, “ঘুটে পুড়লে গোবর হাসে।” হঠাৎ করে আমার দিদির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। জনা পনেরো বন্ধুকে নিমন্ত্রণের অধিকার বাবা আমাকে দেওয়ার সময় বলে দিলেন, যেন আমি কোনোভাবেই ষষ্ঠীকে না নিমন্ত্রণ করি। আমি তো পড়লাম বেজায় মুশকিলে!
মা'কে ধরলাম, বললাম ষষ্ঠীকে নিমন্ত্রণ করতেই হবে, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করাও। প্রয়োজনে আমি দশজন বন্ধু আর ষষ্ঠীকে বলবো, ওকে বলতে না দিলে, আমি একজনকেও বলবো না। মা অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করিয়েছেন, তবে শর্ত হচ্ছে ষষ্ঠী ভদ্রসভ্য হয়ে খাবে, ওর খাওয়া নিয়ে যেন কোনো সিনক্রিয়েট না হয়।
সেই আশির দশকে কেটারিং-এর এতো রমরমা ছিল না, বিয়ের আগের দিন রাত্রে বাড়িতে ভিয়েন বসতো, রসগোল্লা, পান্তুয়া, সন্দেশ, বোঁদে তৈরী হতো, খাবার পরিবেশন করতো পাড়ার ছেলেরা।
বাবার ক্রুদ্ধ মুখে করুণ হাসি এড়াবার একটা বুদ্ধি আমার মাথায় খেলে গেলো, ষষ্ঠীকে বললাম “তুই ভাঁড়ার ঘর সামলাবি, মাছ, মিষ্টির হিসাব রাখবি, আর ফাঁকতালে যা খুশী যতখানি ইচ্ছা খেয়ে নিবি।
তখন রাত প্রায় বারোটা, বিয়েবাড়ি অনেকটা ফাঁকা। ষষ্ঠীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিকমতো খেয়েছিস তো? উত্তরে ও বললো ” না, তেমন কিছু খাইনি, মোটে গোটা চল্লিশ মাছ, খান পঞ্চাশ রসগোল্লা, পান্তুয়া আর সন্দেশ ঐ তিরিশ পঁয়ত্রিশটা করে। ” সব শুনে আমি ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম, যাক্ বাবা, দিদির বিয়েটা নির্বিঘ্নে উতরে গেল ।
এবার এক বিচ্ছিরি ঘটনার কথা বলবো। এযুগে বাঙালি মনন থেকে যেমন আধ্যাত্মিকতা ও ভক্তি বাদ হয়ে গেছে, ঠিক তেমনই এই ঘটনার পর আমাদের বন্ধুমহলে নিমন্ত্রণের ক্ষেত্রে ষষ্ঠী-বাদ-এর পত্তন হয়।
ষষ্ঠী বহু কেরামতী করে তিন বারের চেষ্টায় স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বুঝেছে এ পথ তার পথ নয়, আমিও তার এই মহৎ উপলব্ধির সাথে যখন সহমত হলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, কলেজের প্রথম বর্ষ, পারিবারিক চাপে ফেরার পথ একেবারে রুদ্ধ।
যাইহোক কলেজে এক ইয়াং, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম নতুন অধ্যাপক জয়েন করেছেন, কথাবার্তা, পড়ানো ও ছাত্রদের সাথে বন্ধুর মতো মেশার গুণে তিনি ইতিমধ্যেই ভীষণ পপুলার হয়ে উঠেছেন। এদিকে আমার কলেজের এক বন্ধু তার দাদার বিয়েতে স্যারকে নিমন্ত্রণ করে বসেছে, যেতে হবে অজ পাড়াগাঁয়ে, রাতে ফেরার ট্রেন না থাকায় ই গ্রামেই কাটাতে হবে রাত। এই রকম একটা এডভেঞ্চারাস ব্যাপার শুনে স্যার যেতে রাজি হয়ে গেছেন।
সমস্যা হচ্ছে, আমার সঙ্গে থাকার সুবাদে আমাদের ষষ্ঠীকেও সেই বন্ধু নিমন্ত্রণ করে ফেলেছে, স্যার যাবেন শুনে ষষ্ঠীকে নিয়ে আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়লাম, স্যারের প্রেস্টিজ না পাংচার করে দেয়!
বিয়েবাড়িতে রাত্রে খেতে বসার সময় আমার লক্ষ্য ছিল ষষ্টীকে দূরে রাখতে স্যারের পাশের চেয়ারটা যে কোনো ভাবেই হোক দখল করা। লম্বা লম্বা টেবিল চেয়ারে খাবার ব্যবস্থা। ওমা! হঠাৎ আবিষ্কার করলাম কখন ফাঁক গলে ষষ্ঠী আমাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে ঠিক ঐ চেয়ারটাই দখল করে নিয়েছে। অগত্যা আমি বাধ্য হয়ে ষষ্ঠীর পাশের চেয়ারে বসলাম ও ফিসফিস করে বারেবারে ওকে সাবধান করে চললাম যাতে কোনো বেয়াদবি না করে।
খাওয়া দাওয়া চলছে সুষ্ঠ ভাবেই, এবার রসগোল্লা পরিবেশিত হচ্ছে, ঠিক স্যারের আগে বসা অচেনা লোকটির পাতে যেই না ধবধবে সাদা চারখানা রসগোল্লা পড়েছে, ওমনি লোডশেডিং।
মিনিট চারেক বাদে জেনারেটার চালু হতেই, সেই গ্রাম্য অচেনা লোকটি দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচাতে লাগলেন " আমার রসগোল্লা কোথায় গেলো", আর সন্দেহ জনক চোখে একদৃষ্টে স্যারের দিকে চেয়ে রয়েছেন। উনি যে কলেজের অধ্যাপক, সম্মানীয় ব্যক্তি, তা ওই অচেনা লোকটির জানার কথা নয়। স্যার অপ্রস্তুত, হতভম্ব। উনি পরীক্ষার খাতায় রসগোল্লা অনায়াসে বিলি করতে সিদ্ধহস্ত, কিন্তু তা বলে বিয়েবাড়িতে অন্যের পাতে পড়া রসগোল্লা উদরীকরণের বিরল কৌশল তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয়! কেবল আমিই জানি ঐ অন্ধকারের সুযোগে রসগোল্লা ঘুরপথে কোন পাকস্থলিতে তার অন্তিম যাত্রা শেষ করেছে।
ষষ্টী নির্লিপ্ত মুখে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।