অ্যান্টিবায়োটিক কীভাবে তৈরি হয়?
দু’টি শব্দ আছে। একটি অ্যান্টিবায়োটিক অন্যটি হল অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল। আমাদের যেমন ঘাম হয় তেমনি ছোট ছোট মাইক্রোদের গা থেকে জলের মতো জিনিস বের হয়। এটা নিজেদের বাঁচার জন্যই ওরা বের করে। এই নিঃসরণ থেকেই ওষুধ বানিয়ে ব্যাকটেরিয়া মারার কাজ করি। অ্যান্টি মাইক্রোবিয়ালের অধীনে অ্যান্টি বায়োটিক, অ্যান্টি ভাইরাল বা অ্যান্টি ফাঙ্গাস সবই পড়ে।
অ্যান্টিবায়োটিকের তো একটা ডোজ আছে। ডাক্তাররা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খেতে বলেন। যদি তার আগেই রোগ সারে, তাহলেও কি পুরো ডোজ সম্পূর্ণ করতে হবে?
ডাক্তাররা রোগীর শরীর ও রোগের উপর নির্ভর করেই ওই ডোজ দেন। ব্যাকটেরিয়া সাধারণত দ্রুত দেহে বংশবৃদ্ধি করে। অ্যান্টিবায়োটিক হয় সেটিকে ধ্বংস করে, না হয় তার বংশবৃদ্ধি রোধ করে দেয়। যাতে একটা সময় পরে দেহের সক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে পরোক্ষে মেরে দেয়। তাই ওই ডোজ সম্পূর্ণ করাটাই উচিত।
যদি সেই ডোজ সম্পূর্ণ না করি, তবে কী ক্ষতি হতে পারে?
সেক্ষেত্রে দু’টো জিনিস হতে পারে। প্রথমত ওই ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি ধ্বংস হল না। সেক্ষেত্রে যেগুলি বেঁচে থাকবে, সেগুলি কিন্তু ওই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ফেলল। ফলে রোগ আবার হবে। কিন্তু তখন ওই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। শুধু তাই নয়, সমগ্র সমাজই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, ওই প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাকটেরিয়া হাঁচি, কাশি, কথা বলার মধ্য দিয়ে অন্যের শরীরে ঢুকে যায়। এভাবে জীবাণু ছড়াতে ছড়াতে প্রায় সকলেরই দেহে ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটবে। তখন দেখা যাবে ওই এলাকাতেই কারও ক্ষেত্রেই ওই অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হবে না। দ্বিতীয়ত, ওই ব্যাকটেরিয়া থেকে অন্য কোনও ব্যাকটেরিয়া তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। এই নতুন ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কোনও ওষুধ কাজ করতে পারে না। ক্রিটিকাল কেয়ার বা বাচ্চাদের ইউনিটে গেলে দেখতে পাবেন মাঝে মধ্যে কী অসহায় অবস্থা তৈরি হয়। কোনও অ্যান্টি বায়োটিক কাজ করছে না। আসলে, ডোজ কমপ্লিট না করার ক্ষতিটা তখনই হয়তো রোগী বুঝতে পারেন না। বোঝেন অনেক পরে, বিশেষ করে যখন তিনি দেখেন কিডনিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা অন্য বড় কিছু হয়েছে।
অসম্পূর্ণ ডোজ কি কিছুদিন বাদে আবার চালু করা যায়?
কখনও হয় ঠিকই। যদি দেখা যায় ওই একই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ব্যক্তি সংক্রামিত হয়েছেন। কিন্তু অন্য ধরনের জীবাণু দ্বারা ব্যক্তিটি সংক্রামিত হলে সেই ডোজ চালু করে লাভ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল সমস্যাটা একই কি না। এটা তো কোনও রোগী ধরতে পারবেন না। উপসর্গ বোঝা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। মানুষ জ্বর বাড়ছে না কমছে, পেটে ব্যথা হচ্ছে কি না, সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কী তফাৎ সেটা তাঁরা ধরতে পারবেন না। তাই ওষুধ হঠাৎ বন্ধের পর শরীর ফের খারাপ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই হবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে যে কথা বললেন, তা কি যে কোনও ওষুধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য?
না সব ওষুধের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য নয়। নন কমিউনিকেবল রোগ যেমন হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসের মতো রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ নিয়মিত খাওয়া উচিত। লাইফ স্টাইল ঠিক রাখতে হয়। এগুলি কিন্তু দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া মাঝপথে ওষুধ ছাড়াও উচিত নয়, মাত্রাও পরিবর্তন করা উচিত নয়। তবে সাধারণ সংক্রমণ বা জ্বরের মতো রোগের ক্ষেত্রে এই শর্ত প্রযোজ্য নয়। বরং বলাই হয়, এটা হলে তবেই খাবেন। যেমন বলা হয়, জ্বর এলে তবেই এটা দেবেন। কাশি হলে কাফ সিরাপ খাও।
আমরা তো সাধারণ নানাবিধ রোগের জন্য দোকান থেকে ওষুধ কিনি। অথবা কেউ কেউ বলেও দেন এই ওষুধটা ব্যবহার করুন, রোগ সেরে যাবে। এই অভ্যেস কতটা বিজ্ঞানসম্মত?
একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। যিনি দিচ্ছেন তিনি হয়তো ভালোর জন্যই দিচ্ছেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা হয়তো পয়সা বাঁচানোর জন্য ডাক্তার এড়িয়ে যাই। কিন্তু এই অভ্যেস ক্ষতিই করে। কারণ মনে রাখা দরকার সব কিছুতেই বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাই আদতে কী রোগ হয়েছে সেটা আমরা সঠিকভাবে না বুঝেই ওষুধ খেয়ে ফেলি। দোকানদার রোগীর মুখের কথা শুনে একটা ওষুধ দিয়ে দেন। গায়ে ব্যথা হচ্ছে শুনে, হয়তো বিশেষ গোত্রের বেদনানাশক দিয়ে দিলেন। সেই ওষুধ খেয়ে আপনার ব্যথা কমে গেল! কিন্তু কেউ জানলই না, ওই ব্যথার আসল কারণ হয়ত কিডনিতে সমস্যার কারণে। ফলে ব্যথা কমে গেল, কিন্তু মূল সমস্যাটা রয়ে গেল। এভাবে দিনের পর দিন ধরে বেদনানাশক খেয়ে উপসর্গ কমানো হল, কিন্তু মূল সমস্যাটা আয়ত্ত্বের বাইরে চলে গেল। ফলে রোগীর যখন প্রকৃতপক্ষেই কিডনির সমস্যা হয়তো যখন জানবে তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তাই না জেনেই ওই ওষুধ দিলে পরোক্ষে ক্ষতিই হয়ে যায়।
আচ্ছা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক কি একসঙ্গে খাওয়া যায়?
হ্যাঁ, খাওয়া তো যেতেই পারে। প্রয়োজন পড়লে দেওয়া হয়ও। একাধিক অঙ্গের প্রয়োজনে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। আবার দেখা যায়, রোগীকে একটা ওষুধ দিয়ে বাঁচানো যাবে না। তখন দ্বিতীয় অ্যান্টিবায়োটিক যোগ করা হয়। তবে সবটাই হয় রোগীকে পরীক্ষা করে।
অনেক সময়ই দেখা যায় ডাক্তারবাবু অ্যান্টিবায়োটিক পাল্টে দিলেন বা মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন…
দেখুন, চিকিৎসা বিজ্ঞান ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। মূল্যায়ণ করতে হয়। আমরা রোগীকে পরীক্ষা করে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা অ্যান্টিবায়োটিক দিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে কয়েকটা পরীক্ষাও দিলাম। এর ফলে চিকিৎসক রোগীর অসুখ সম্পর্কে ভাবনাটা ঠিক কি না, তা মিলিয়ে নিতে পারেন। এটা একটা পুনর্মূল্যায়নের বিষয়। কিন্তু আবার বলছি, এই ডোজ বা ওষুধ পরিবর্তনের যৌক্তিকতা রয়েছে। দেখবেন, ডাক্তারবাবু হয়তো প্রথমে ৫০০ এমএল ডোজের ওষুধ দিলেন। কিন্তু পরে তিনিই বললেন ১০০০ খাও। সবটাই রোগ আর রোগীর উপর নির্ভর করে। কিন্তু রোগী নিজে থেকে কম ডোজ খেল বা সময় কমালো, সেটা ঠিক নয়।
একই গ্রুপের সব অ্যান্টিবায়োটিকের গুণগত মান এক?
হিসেব মতো এক হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন। তার উপর ওষুধের দাম নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে দেখা যাবে জাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে, কম গুণের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। তাই দেখবেন অনেক সময় একটা অ্যান্টিবায়োটিক ভালো কাজ দিয়েছে। কারণ সেটার গুণগত মান ভালো। কিন্তু অন্য ওষুধটা তেমন কাজ দিচ্ছে না।
ঘন ঘন বা যখন তখন অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াটা কি ঠিক?
অযথা ওষুধ খাওয়াই ঠিক নয়। দোকানদার বা লোকের পরামর্শ মেনে ওষুধ না খেয়ে ডাক্তারের কথা শোনা উচিত। নিজের ডাক্তারি নিজে করা ঠিক নয়। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া তো উচিত নয়ই। এমনিতেই খুব কম সংখ্যক অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের হাতে রয়েছে। তার উপর যথেচ্ছ এবং ভুল পদ্ধতিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ফলে বহু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি হচ্ছে। তাই বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যাও ক্রমশ কমে আসছে। তাই বারবার বলা হচ্ছে, খুব প্রয়োজন না হলে অ্যান্টি বায়োটিক ব্যবহার করবেন না। এখন মানুষের সচেতনতাই আমাদের ভরসা।